মণিপুরের মায়েরা যেন মহাশ্বেতার দ্রৌপদী।
যে বারবার ধর্ষিত, অত্যাচারিত হয়েও উঠে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের উলঙ্গ-উল্লাস ঢাকা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র তাঁর গায়ে চাপিয়ে দিয়েছে যে পাতলা কাপড়, এক টানে তা ছিঁড়ে ফেলেছেন এই মা। ‘উলঙ্গ’ দ্রৌপদী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন সেনানায়কের সামনে। সমাজের সামনে। পিছতে জানেন না আমার মণিপুরের মায়েরা। তাই মশাল হাতে এগিয়ে চলেছেন তাঁরা। একা নন। হাজার হাজার মা শামিল হয়েছেন এই মশাল-যাত্রায়। হয়তো আরও একটা নুপি লান দেখার অপেক্ষা!
শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, মানুষ বড় সস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো…।
আর যদি সে মেয়ে হয়, তাহলে কি তাঁর শরীরকে যেমন খুশি ভোগ করা যায়?
বারবারই এই প্রশ্ন উস্কে দিচ্ছে মণিপুর। শিউড়ে ওঠা দৃশ্য দেখে নিজেকেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, হাজার বছর ধরে বয়ে বেড়ানো যন্ত্রণা, এই মৃত্যু উপত্যকা সত্যিই কি আমার দেশ!
প্রশ্ন আরও, জাতিহিংসা কি তালিবান শাসনের থেকেও ভয়াবহ?
ধর্ষণ কি শুধুই বিকৃতকাম? শরীরের লালসা কিংবা কামনা চরিতার্থ করা? নাকি এর মধ্যে লুকিয়ে ক্ষমতার শক্তি প্রদর্শন অথবা প্রতিহিংসার আগুনে নিজেকে সেঁকে নেওয়া।
কাশ্মীর হোক বা দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ কিংবা মণিপুর, প্রতিটি হিংসাতেই রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে যায় নির্যাতিত, ক্ষতবিক্ষত মহিলার দেহ! শুধু দেশ কেন, বিদেশের দিকে তাকালেও ছবিটা একই। সাক্ষী সোমালিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া কিংবা প্যালেস্তাইন।
অবাক লাগে। মনে হয়, সত্যিই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে রয়েছি তো আমরা? অত্যুক্তি হয় না, কবি যখন লেখেন,
‘আমার শরীর যুদ্ধক্ষেত্র
আমার স্তন হল বিজয় পদক
এই পুরুষ রাষ্ট্রে আমি শুধুই এক মাংসপিণ্ড।
ধিক্কার পুরুষ তোমায়
তুমি আমার শরীরে শুধু যোনি দেখতে পাও।’
মোমবাতি জ্বলে-নেভে। মুষলধারে বিকৃতি! উৎসুখ চোখের কারুভাষায় আবার কুরুক্ষেত্র! সম্ভ্রম মাটি ছেঁচড়ে পড়ছে, তবু ধরণী কি দ্বিধা হয়, চিত্রাঙ্গদা!
কী করে চোখ মেলাব আমরা মণিপুরের ‘লৌহমানবী’ ইরম শর্মিলা চানুর চোখে!
তাইতো লীনা গঙ্গোপাধ্যায় চিঠি লেখেন আগুনকে। ‘…মৃত্যুশয্যা থেকে এই প্রথম এবং শেষবারের মতো তোমাকে লিখছি। অনেক স্বপ্ন ছিল, আমার অতীত, আমার দু’চোখ উপচে পড়া পাহাড়ি নদীর কণা। পাখির গানের মতো সুরেলা সেই চিঠি পাহাড়ি নদীতে কাগজের নৌকায় পপি ফুল দিয়ে সাজিয়ে তোমার কাছে পাঠাব ভেবেছিলাম। হয়ে ওঠেনি। অপেক্ষা ছিল সেই আশ্চর্য লগ্নের। যখন লগ্ন এল, দেখলাম, তোমার আর আমার মাঝখানে যে রক্তলাল ফুলেরা আমাদের মনে ভালোবাসার রং ছুঁইয়ে দিয়েছিল, তারা ঝরে গিয়েছে কখন আমাদের অজান্তেই। তাই এই চিঠিতে আজ ঝলসানো পোড়া মাংসের কটূ গন্ধ, মৃত্যুর শীতলতায় নিগর। কণাগুলোর শরীরে আজ শুধু পিস্তল থেকে ছুটে আসা আগুনের গোলার চিহ্ন।’
প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ‘ক্যানভাস’ করা হয়েছে নারী শরীরকে। সেই শরীরে এঁকে দেওয়া হয়েছে ধর্ষণের আঁচড় আর গুলির চিহ্ন। নৃশংস বর্বরতা। লজ্জায় মাথা হেট ভারতবর্ষের। নিজের চামড়া ছিঁড়ে নগ্ন নারীকে বসন পরানোর আর্তি ঝরেছে কবির কলমে। তবুও বদলায় না ছবি। শুধু বদলে যায় ধর্ষণের ‘লিপি’।
বীর নারীদের রাজ্যে এ কোন রূপ! ঝনঝন করে সময় ভাঙছে কেবল! মনে পড়ে সব্যসাচী দে’র লেখা কবিতাটি।
‘বারেবারে আমাকে সন্তানবতী করেছে পুরুষ কিন্তু/তারা প্রত্যেকেই আমার আকাঙ্খিত নয়…।’
মণিপুরের ইতিহাস নিয়ে বাংলাভাষায় অনবদ্য প্রবন্ধ গ্রন্থটি এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশ করেছে সেন ব্রাদার্স। বইটির লেখক সাংবাদিক ব্রতীন দাস। উত্তাল সময়ে এ বই শুধু পাঠ করার জন্য নয়, জীবন্ত দলিল হিসেবে ধরা দিয়েছে পাঠকের কাছে। বইমেলায় ১১০ নম্বর স্টলে পাওয়া যাচ্ছে ‘আমার মণিপুরের মা’। দাম ২৫০ টাকা।