দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ আইপিএলের সৌজন্যে এই নামটা বোধহয় ভুললে চলবে না। শেষ ওভারে প্রয়োজন ২৯ রান। হাতে মাত্র ৩ উইকেট। কেকেআরের ডাগআউট হাল ছেড়ে দিয়েছে। নিয়মরক্ষার ওভার, শেষপর্যন্ত কত রানে নাইটরা হারে তারই অপেক্ষা। সেই হারা ম্যাচকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়লেন রিঙ্কু সিং। যশ দয়ালের শেষ পাঁচ বলে পাঁচ ছক্কা। রোমহর্ষক ম্যাচ। অবিশ্বাস্য জয়। আইপিএলের অন্যতম সেরা বললে ভুল হবে না। অবশেষে রিঙ্কু সিংয়ের দাক্ষিণ্যে অসম্ভবকে সম্ভব করল নাইটরা। শেষ বলে ছয় মেরে কেকেআরকে ৩ উইকেটে জেতালেন বাঁ হাতি। দৌড়ে মাঠে ঢুকে ম্যাচের নায়ককে কোলে তুলে নিলেন অধিনায়ক নীতিশ রানা। ২১ বলে ৪৮ রানে অপরাজিত রিঙ্কু।
কেন তাঁকে দলের মালিক শাহরুখ খান স্পেশাল মানিব্যাগ দিয়েছিলেন একটা সময়ে, সেটি বোঝা যাচ্ছে। তিনি দলের চিয়ারলিডারও, সারাক্ষণ হাসির কথা বলে শিবিরকে মাতিয়ে রাখেন।
এত আলোর মধ্যেও রিঙ্কুর অতীত বড়ই করুণ। তিনি উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ের ছেলে। বাবা গ্যাস সিলিণ্ডার বয়ে বেড়ান, দাদা অটো চালান। তার মধ্যেও বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখে ক্রমেই কেকেআর দলে জাত চিনিয়েছেন। একটা সময় পাঞ্জাব তাঁকে কিনেছিল ২০ লক্ষ টাকায়। সেই টাকা এবারই কোটি স্পর্শ করেছে। তাঁকে নাইটরা দিয়েছেন দেড় কোটি টাকা।
এদিন ম্যাচ শেষে সেই রিঙ্কু বলেছেন, ‘‘আমি জানতাম উইকেটে থাকলে এই রান টপকে যাওয়া সম্ভব। আসল কাজটি করে দিয়ে গিয়েছিল আমাদের নেতা নীতিশ রাণা ও বেঙ্কটেশ আইয়ার। পরে আমি কাজটি শেষ করে দিয়েছি। আমি এই জয় দলকে উৎসর্গ করছি।’’
রিঙ্কু এসব আজ বলতেই পারেন, কারণ তিনি তামাম কেকেআর সমর্থকদের কাছে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। আর আলিগড়ের নবাব।
আইপিএলের ইতিহাসে ম্যাচটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। রিঙ্কু মনে করালেন কার্লোস ব্রেথওয়েটকে। একইভাবে ইডেনে বেন স্টোকসের শেষ ওভারে পরপর ছয় মেরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টি-২০ বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডার। এদিন যেন তারই পুনরাবৃত্তি। তবে ম্যাচের এই পরিস্থিতিতে একজন আনক্যাপড, অনভিজ্ঞ তরুণের এই কীর্তি দীর্ঘদিন মানুষের মনে থেকে যাবে। পেন্ডুলামের মতো একাধিকবার ম্যাচের পট পরিবর্তন হয়।
একটা সময় মনে হয়েছিল তিন বলেই শেষ কলকাতা নাইট রাইডার্স। গুজরাটের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে হারের মুখে পৌঁছে গিয়েছিল নাইটরা। সৌজন্যে রশিদ খান। আঙুলের ভেল্কিতে বদলে দিয়েছিলেন ম্যাচের রং।২০৪ রান তাড়া করতে নেমে ভেঙ্কটেশ আইয়ারের দুরন্ত ইনিংসে ভর করে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল নাইটরা। শেষ বল পর্যন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাচ্ছিল। জয়ের জন্য তখনও প্রয়োজন ৫১ রান, হাতে ২৪ বল। টি-২০ ক্রিকেটে এই অঙ্ক আয়ত্তের মধ্যে। তখনও আন্দ্রে রাসেল, রিঙ্কু সিং, শার্দূল ঠাকুরের উইকেট হাতে রয়েছে। আগের ম্যাচে শেষের দু’জনের দাপটেই জিতেছিল কেকেআর।
কিন্তু ১৭তম ওভারের প্রথম তিন বলেই হ্যাটট্রিক রশিদের। পরপর ফেরান রাসেল, নারিন এবং শার্দূলকে। এরপরও যে রিঙ্কু ম্যাজিক বাকি ছিল সেটা বোধহয় ক্রিকেট পণ্ডিতরাও ভাবেননি। এই জায়গা থেকেও হারা সম্ভব ভাবতেই পারেননি রশিদ। নয়তো শেষ ওভারের জন্য কেন রেখে দিলেন যশ দয়ালের মতো একজন আনকোড়া, অনভিজ্ঞ বোলারকে! যে কিনা নিজের প্রথম ওভার থেকেই অতিরিক্ত রান দিচ্ছেন। শেষপর্যন্ত ৪ ওভার বল করে ৬৯ রান দেন যশ। এখানেই গুজরাটের জেতা ম্যাচ ফসকে যায়।
রবিবাসরীয় বিকেল ছিল বিজয় শঙ্করের। অবিশ্বাস্য ইনিংস তামিলনাড়ুর ক্রিকেটারের। ২১ বলে ৫১ রান। শেষপর্যন্ত ২৪ বলে ৬৩ রানে অপরাজিত। কেরিয়ারের সেরা ইনিংস বিজয়ের। আগ্রাসী ইনিংসে ছিল ৫টি ছয় এবং ৪টি চার। তারমধ্যে শেষ ওভারে শার্দূলের বলে তিনটে ছক্কা। নাইটদের ডেথ বোলিং জঘন্য। শেষ দু’ওভারেই ম্যাচ হাতের বাইরে বেরিয়ে যায়। আইপিএলে একাধিক ম্যাচ খেললেও সেইভাবে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি বিজয়।
এদিন রানের পাহাড় তাড়া করতে নেমে শুরুতেই জোড়া ধাক্কা নাইট শিবিরে। মাত্র ২৮ রানের মধ্যে ২ উইকেট হারায় কেকেআর। রান পাননি দুই ওপেনার রহমতুল্লা গুরবাজ (১৫) এবং নারায়ণ জগদিশান (৬)। পাওয়ার প্লের শেষে ২ উইকেটে হারিয়ে ৪৩ রান ছিল কেকেআরের। এরপর হাল ধরেন ভেঙ্কটেশ আইয়ার এবং নীতিশ রানা। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে সুয়াশের পরিবর্তে নামেন ভেঙ্কি। প্রথম দুই ম্যাচে রান না পেলেও এদিন ছয় মেরে শুরু করেন। ছন্দে ফেরেন গতবছরের আবিষ্কার।
২৬ বলে অর্ধশতরান সম্পূর্ণ করেন ভেঙ্কটেশ। তাতে ছিল ৩টি ছয় এবং ৫টি চার। অনবদ্য ইনিংস। ১১তম ওভারে একশোর গণ্ডি পার করে কেকেআর। চার, ছয়ের ফুলঝুরি বইয়ে দেন ভেঙ্কি। উইকেটের অন্য প্রান্তে দারুণ নীতিশ রানাও। মাত্র ৫৪ বলে তৃতীয় উইকেটে ১০০ রান যোগ করে এই জুটি। পার্টনারশিপ ভাঙেন আলজারি জোসেফ। ৪৫ রানে ফেরেন নাইট অধিনায়ক। তবে অপ্রতিরোধ্য ছিলেন ভেঙ্কটেশ। অতি সহজেই একের পর এক বড় শট খেলেন। দুর্ধর্ষ ইনিংস থামান আলজারি জোসেফ। মাত্র ৪০ বলে ভেঙ্কটেশের চোখ ধাঁধানো ৮৩ রানের ইনিংস শেষ হয়।
এরপর রশিদ ম্যাজিক। ৩ ওভার বল করে ৩৫ রানে কোনও উইকেট নেই। ১৭তম ওভারে বল করতে এসে প্রথম তিন বলেই হ্যাটট্রিক রশিদ খানের। বদলে দিয়েছিলেন ম্যাচের রং। ১৫৪ রানে ৪ উইকেট থেকে রাতারাতি ১৫৫ রানে ৭। এরপর বাকিটা ইতিহাস। এই জায়গা থেকে একার হাতে দলকে অবিশ্বাস্য জয় এনে দেন রিঙ্কু সিং।