দেশের সময়: চাকরি বাতিল ও ডিএ ইস্যুর জোড়া ফলায় বিদ্ধ রাজ্য সরকার। আর এই দুই ইস্যুর হাত ধরে পঞ্চায়েত ভোটের আগে বাড়তি অক্সিজেন যোগ হচ্ছে বিরোধী শিবিরে। এমনিতেই সাগরদিঘি মডেল অর্থাৎ সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপির অলিখিত জোট খানিকটা হলেও চিন্তা বাড়িয়েছে তৃণমূল শিবিরে।
মুখে না বললেও আড়ালে আবডালে জোড়াফুলের নেতারা মানছেন, বিরোধীরা একজোট হয়ে গেলে হাওয়া ঘুরতে পারে। তার উপর হাইকোর্টের রায়ে যেভাবে একের পর এক চাকরি যাচ্ছে, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বেকার হয়ে পড়ছেন, ভোটবাক্সে তার কতটা বিরূপ প্রভাব পড়বে, প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তা নিয়ে। সেইসঙ্গে ডিএ নিয়ে আন্দোলনের ঝাঁঝ বাড়াচ্ছেন রাজ্য সরকারের কর্মীরা। এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাছে এখন গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো। কারণ, সরকারি কর্মীরা অসহযোগিতার পথে হাঁটতে থাকলে প্রশাসন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে সরকারের পক্ষে। আর সেটা বুঝেই এখন ডিএ নিয়ে আন্দোলনকারীদের নরমে গরমে রাখতে চাইছে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
কখনও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, আমার মুণ্ড কেটে নিলেও এর বেশি ডিএ দিতে পারব না। পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে কি পেনশন বন্ধ করে ডিএ দেব? অন্যদিকে, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ডিএ নিয়ে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে সুর চড়িয়ে বলছেন, দিল্লিতে গিয়ে আন্দোলন করুন। বাংলার বকেয়া আদায় করে নিয়ে আসুন। বাংলার মানুষ কর্মনাশা বন্ধ প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে এসব করে কোনও লাভ হবে না। তাঁদের এসব কথাবার্তা থেকেই স্পষ্ট, রাজ্য সরকার যথেষ্টই চাপে। তৃণমূল নেতৃত্বের অবশ্য বক্তব্য, কোনও ইস্যুতেই কিছু যায় আসে না। বাংলার মানুষ জানেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী করছেন। কতটা করছেন। কী পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সরকার চালাচ্ছেন। আগের সরকারের আমলে রাজ্যের মানুষ কী সুবিধা পেতেন, আর এখন মানুষ কী পান। ফলে বিরোধীরা যতই জল ঘোলা করার চেষ্টা করুক না কেন, রাজ্যের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের সঙ্গেই আছেন ও থাকবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
শুক্রবার রাজ্যের সরকারি দফতরগুলিতে ডিএ ধর্মঘটের কোনও প্রভাব পড়েনি বলে জানিয়েছে নবান্ন। প্রেস বিবৃতিতে তাদের দাবি, ওইদিন ৯০ শতাংশ কর্মীই যথাসময়ে অফিসে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন। ফলে কোনও দফতরের কাজেই প্রভাব পড়েনি। মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। তবে যাঁরা অফিসে না এসে ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে নবান্নের তরফে। বকেয়া মহার্ঘভাতার দাবিতে শুক্রবার ঘর্মঘটে শামিল হয়েছিলেন রাজ্যের সরকারি কর্মীরা। তার আগের দিনই অবশ্য নবান্নের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেওয়া হয়, ঘর্মঘটের দিন গরহাজির থাকলে বেতন কাটা হবে। যদি একান্তই কেউ অফিসে না আসেন, তাঁদের ক্ষেত্রে শর্ত যোগ দেওয়া হয়েছিল।
এই ধর্মঘটের দিনেই বজবজে নবনির্মিত চড়িয়াল সেতুর উদ্বোধন করে সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, যখন চারদিকে অবরোধ হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সেই সময় সরকারি কর্মীরা নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের স্বার্থে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করছেন, তাঁদের কুর্নিশ। একইসঙ্গে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যাঁরা ধর্মঘট ডেকেছেন, ডাকতেই পারেন। এটা তাঁদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু বাংলার মানুষ আর কর্মনাশা ধর্মঘট, বন্ধ মানবেন না। আন্দোলনকারীদের দিল্লি গিয়ে আন্দোলন করারও বার্তা দেন অভিষেক।
বলেন, যারা ডিএ নিয়ে আন্দোলন করছেন, তাঁদের বলব, দিল্লি গিয়ে আন্দোলন করুন। তাঁরা যদি নিজেদের বাংলার সন্তান বলে মনে করেন, তা হলে দিল্লি গিয়ে রাজ্যের বকেয়া ফিরিয়ে আনুন। বাংলা আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলছে। তারই মধ্যে যাঁরা ব্ল্যাকমেলিং পলিটিক্স করছেন, তাঁরা এক মুহুর্তও ভাবছেন না যে, কেন্দ্র ১ লক্ষ ১৫ কোটি টাকা দেয়নি। বাংলার ১৭ লক্ষ পরিবার একশো দিনের কাজের টাকা পায়নি।
অভিষেকের আগেই অবশ্য ডিএ নিয়ে রাজ্য সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে রাজ্য সরকারি কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমার মুণ্ড কেটে নিন। কিন্তু এর বেশি ডিএ দিতে পারব না। মমতার বক্তব্য, ১০৫ শতাংশ ডিএ দিচ্ছি। আর কত চাই? কত দিলে সন্তুষ্ট হবেন? আরও চাইলে আমার মুণ্ড কেটে নিন। কিন্তু এর চেয়ে বেশি আর আমার কাছ থেকে পাবেন না। একইসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, দেশের কোনও রাজ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীদের পেনশন দেওয়া হয় না। তা হলে কি আমরাও বন্ধ করে দেব। পেনশন বন্ধ করে দিলে হাতে কিছু টাকা থাকবে। তখন ডিএ দিতে পারব। তাঁর বার্তা, ডিএ বাধ্যতামূলক নয় যে, দিতেই হবে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের বেতনের স্কেল আলাদা। রাজ্য সরকারের কর্মীরা ছুটিও অনেক বেশি পান। দু’টোকে এক করে ফেললে চলবে না।
বিজেপি অবশ্য ডিএ ইস্যুতে আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, রাজ্য সরকারকে বকেয়া ডিএ দিতেই হবে। এমনকী ২০১৫ সাল থেকে যে বকেয়া রয়েছে, রাজ্য সরকারকে সেটাও মেটাতে হবে।