দেশের সময়: সারি সারি দোকান। কোনও দোকানে বিক্রি হচ্ছে পান, বিড়ি, সিগারেট। কোনও দোকানে আবার বিকোচ্ছে মদ, ঠাণ্ডা পানীয়। আর এইসব দোকানের সঙ্গেই রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুম। সেই ঘরেই চলে যৌনপেশা।

ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া আসানসোলের ‘দিশা’য় এই যৌনপল্লিতে মেয়েদের সামনে রেখে দিন দিন বাড়ছিল দালালরাজ। একবার কোনও ‘খদ্দের’ পেলে হল। তাকে নানাভাবে ফাঁসিয়ে কার্যত সর্বস্ব ‘লুট’ চলছিল। টাকা না থাকলে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছিল ঘড়ি, মোবাইল ফোন থেকে এটিএম কার্ড, ল্যাপটপ পর্যন্ত। এভাবে খদ্দেরদের কাছ থেকে ছিনতাই চললেও মেয়েদের জুটছিল না তার সিকিভাগও। আবার দিনের পর দিন ধরে চলা এই লুটতরাজ নিয়ে পুলিশকে জানিয়েও মিলছিল না সুরাহা। অবশেষে শক্তহাতে হাল ধরল ‘দুর্বার’ মহিলা সমন্বয় সমিতি। টাঙিয়ে দেওয়া হল ‘রেটচার্ট’।

তাতে উল্লেখ করা হয়েছে মদের দাম থেকে ঘরভাড়া এমনকী যেসমস্ত ‘খদ্দের’ যৌনপল্লিতে আসছে, তাদের কাছ থেকে কত টাকা নেওয়া যাবে, তার সবটাই। যৌনপল্লিতে এ ধরনের রেটচার্ট রাজ্যে এই প্রথম বলে জানিয়েছেন দুর্বারের জনসংযোগ আধিকারিক মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়। শুধু রেটচার্ট টাঙানোই নয়, বাইরে থেকে কোনও দালাল যাতে যৌনপল্লিতে ঢুকতে না পারে, সেজন্য সেখানে ব্যবস্থা করা হয়েছে রাত পাহারার।

মেয়েদের পাশাপাশি যৌনকর্মীর সন্তানরা পালা করে প্রতি রাতে পাহারা দিচ্ছেন ওই এলাকায়। দুর্বারের এই উদ্যোগ দেখে এখন এগিয়ে এসেছে পুলিশ প্রশাসনও। তারাও পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে।

অন্যদিকে, দুর্গাপুরের কাদারোডের যৌনপল্লিতে অপরাধ রুখতে এবং যাতে কোনওভাবেই দুষ্কৃতীরা আশ্রয় নিতে না পারে, সেজন্য দুর্বারের তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাত এগারোটার পর সেখানে কোনও খদ্দের ঢুকতে পারবে না। এই নিয়ম ভেঙে যদি কোনও মেয়ে খদ্দের ঢোকায়, সেক্ষেত্রে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে তার ঘরে। এনিয়ে দিন কয়েক আগে দুর্বারের তরফে সেল্ফ রেগুলেটারি বোর্ডের মিটিংও করা হয়েছে দুর্গাপুর ও আসানসোলের যৌনপল্লিগুলিতে। ছিলেন দুর্বারের সম্পাদিকা বিশাখা লস্কর।

সংগঠনের জনসংযোগ আধিকারিক মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ২০০১ সাল থেকেই রাজ্যের ৩৬টি যৌনপল্লিতে এই সেল্ফ রেগুলেটারি বোর্ড চলছে। নারী পাচার ঠেকানোর পাশাপাশি কোনও নাবালিকাকে যাতে যৌনপেশার জন্য রেড লাইট এরিয়ায় কেউ না নিয়ে আসতে পারে, সেটা নিশ্চিত করাই এই বোর্ডের অন্যতম কাজ। তাছাড়া প্রতিটি যৌনপল্লিতে কিছু না কিছু সমস্যা থাকে। মেয়েরা যে এলাকায় থাকে, সেখানকার উন্নয়নের বিষয়টিও রয়েছে।

এসব নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে ওই বোর্ডে এলাকার জনপ্রতিনিধি, একজন মেডিক্যাল অফিসার, আইনজীবী এবং পুলিসের একজন আধিকারিককে রাখা হয়েছে। নিয়ম করে এই বোর্ডের মিটিং হয়। দুর্গাপুরের বোর্ডে একজন মেয়র ইন কাউন্সিল রয়েছেন। সঙ্গে শহরের একজন নামী চিকিৎসকও রয়েছেন। আছেন আইনজীবী, পুলিশ আধিকারিক। এখানকারের বোর্ড দারুণ কাজ করছে। সেজন্য রাজ্যের বাকি যৌনপল্লিগুলির সামনে দুর্গাপুরের বোর্ডকেই মডেল হিসেবে তুলে ধরছি আমরা।

যৌনকর্মীর সন্তান তথা আসানসোলের দিশা যৌনপল্লিতে দুর্বারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা রবি ঘোষ বলেন, আমাদের এখানে মোট ১৭৪টি দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকানের সঙ্গেই ঘর রয়েছে। সেইসব ঘরে যৌনপল্লি পেশা চলে। কিছু মেয়ে ওই ঘরেই থাকে। অনেকে আবার কিছুটা দূরের লছিপুর, ব্রহ্মচারি, ভাটা রাস্তা এলাকা থেকে বিকেল নাগাদ আসে। রাতে পেশা করে সকাল হলে ফিরে যায়। বর্তমানে এই যৌনপল্লিতে নথিভুক্ত মেয়ের সংখ্যা ৯৩২ জন।

বেশিরভাগ মেয়ে বনগাঁ, বসিরহাট, কৃষ্ণনগরের। কিছু মেয়ে রয়েছে বীরভূম ও বিহারের বেগুসরাইয়ের। কিন্তু বেশকিছু দিন ধরে দালালরাজের জন্য এলাকাটি রীতিমতো অশান্ত হয়ে উঠেছিল। দেখা যাচ্ছিল, বাইরে থেকে বহু লোক এমনকী কম বয়সি ছেলেরাও দালাল হিসেবে এখানে ঢুকে পড়ছিল। এখান থেকে ঝাড়খণ্ড সীমানা ২৫ কিমি দূর। ফলে ঝাড়খণ্ড থেকে অনেক খদ্দেরই এখানে আসে। তাদেরকে নানাভাবে টোপ দিয়ে এখানে নিয়ে আসার পর ওইসব দালালরা তার কাছ থেকে পয়সাকড়ি, দামী জিনিসপত্র লুট করছিল।

দালালরাজ বন্ধ করতেই দুর্বারের উদ্যোগে এখানে রেটচার্ট টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই তালিকার বাইরে কেউ এক টাকাও বেশি নিতে পারবে না। যে বা যারা নিয়ম ভাঙবে, তাদের বিরুদ্ধে সংগঠনের তরফে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গেও আমাদের মিটিং হয়েছে। তারাও এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here