দেশের সময়: বাঁধাকপি তো অনেক খেলেন। কিন্তু লাল বাঁধাকপি!
শুধু মুখের স্বাদ বদলের জন্যই নয়, শরীর সুস্থ রাখতেও এর জুড়ি মেলা ভার। অপ্রচলিত এই সব্জিটির স্বাস্থ্যগুণের শেষ নেই। লাল বাঁধাকপির মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্থোসায়ানিন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এর ফাইটোকেমিক্যালস শরীরে ফ্রি র্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে, বলছেন বিজ্ঞানীরা।
লাল বাঁধাকপিতে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, ই, কে, বি, ডায়েটারি ফাইবার, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, থায়ামিন, ফোলেট এবং রাইবোফ্লাভিন। যার প্রত্যেকটিই সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। এছাড়াও এতে রয়েছে সালফার, যা এর ডিটক্সিফাইং শক্তি ব্যবহার করে শরীরকে রেডিয়েশন এক্সপোজারের হাত থেকে রক্ষা করে এবং পরিপাকতন্ত্রকে সঠিকভাবে কার্যকর রাখে।
আর শুধু লাল বাঁধাকপি নয়, আপনার ডায়েটে ভিন্ন ধরনের খাবারের তালিকায় যুক্ত হতে পারে বেগুনি ফুলকপিও। কিংবা ধরুন গেরুয়া, কমলা বা গাঢ় হলুদ ফুলকপি! রাতের খাবারের টেবিলে সৌন্দর্য তো যোগ করবেই এইসব রামধনু সব্জি। সেই সঙ্গে জোগাবে বাড়তি পুষ্টিও। শরীর থাকবে সতেজ, প্রাণবন্ত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমলা রঙের যে ফুলকপি পাওয়া যায়, আসলে সেটি বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ। আর বেগুনি ফুলকপিতে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় অ্যান্থোসায়ানিন। তবে সবুজ ফুলকপিও পাওয়া যায়। সেটি অবশ্য ব্রোকলি নয়। সাদা ফুলকপি ও ব্রোকলির সংকরায়ণে তৈরি নতুন জাত। পোশাকি নাম ব্রোকোফ্লাওয়ার। যা প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, ভিটামিন এ, বি, কে, সি এমনকী ফোলেট সমৃদ্ধ।
১৯৮৮ সাল নাগাদ বাজারে আসে ব্রোকোফ্লাওয়ার। অন্যদিকে, বেগুনি ফুলকপির আদি বাসস্থান ইতালি কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা। মূলত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অ্যান্থোসায়ানিনের জন্যই এর রং বেগুনি হয়। যা রয়েছে লাল বাঁধাকপির মধ্যেও। সিসিলিয়ান ভায়োলেট, ভায়োলেট কুইন কিংবা গ্রাফিটি ফুলকপি নামেও পরিচিত বেগুনি ফুলকপি। ১৯৭০ সাল নাগাদ কমলা ফুলকপি কানাডার টরন্টো শহরে প্রথম দেখা যায়। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচিত জাতের মধ্যে প্রজননের ফলে তৈরি হয়েছে এইসব রঙিন ফুলকপি। এখন আমাদের রাজ্যেও বহু জায়গাতেই ফলছে বাহারি ফুলকপি ও বাঁধাকপি।
সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে সাদা, হলুদ কিংবা বেগুনি গাজরের প্রচলন ছিল। এর পর হল্যান্ডের রাজ পরিবারের উৎসব উদযাপনকে স্মরণীয় করে রাখতে ডাচ বিজ্ঞানীরা তাতে কমলা রং যুক্ত করেন। বেশ কয়েক বছর ধরে ব্রিটেনের বাজারে বেগুনি গাজর বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। একইসঙ্গে ঠাঁই পেয়েছে হলুদ টম্যাটো কিংবা বেগুনি আলুও। আমেরিকায় অবশ্য রঙিন ফুলকপি অনেক দিন ধরেই পাওয়া যায়। খাদ্যরসিকদের পছন্দের তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছে সে।
বেগুনি মিষ্টি আলুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে লোহা ও পটাশিয়াম। এছাড়াও থাকে ভালো মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা হজমে সাহায্য করে। এই আলুতে প্রচুর মাত্রায় ফাইবার থাকায় শরীরের বাড়তি চর্বি পুড়িয়ে সাহায্য করে বিপাকীয় প্রক্রিয়ায়। যাঁরা পার্পল পট্যাটো চোখে দেখেননি, তাঁরা বাজারে দেখলে মনে করতেই পারেন, এটিতে বোধ হয় কোনও রাসায়নিক দেওয়া হয়েছে। আসলে দক্ষিণ আমেরিকায় এই প্রজাতির আলুর দারুণ কদর। কিন্তু এতদিন সেই অর্থে আমাদের দেশে তেমন চল ছিল না এটির। পেরু ও বলিভিয়ায় এই আলুর উৎপত্তি বলে জানা যায়। তবে আমাদের দেশে সিমলায় প্রথম বেগুনি আলুর চাষ শুরু হয়।
প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় বেগুনি আলু ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে। এই আলু চাষের জন্য বিশেষ কোনও রাসায়নিকের প্রয়োজন হয় না। হেক্টরে ৩৫-৩৮ টন ফলন পাওয়া যায়। অনেকে মনে করতে পারেন, বেগুনি আলু খেলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে। কিন্তু একদমই তেমনটা নয়। অনেকের আবার ধারণা, বেশি আলু খেলে মোটা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিশ্চিন্তে বেগুনি আলু খান। সাদা আলু বা রাঙা আলুর চেয়ে এই আলুতে অনেক বেশি পরিমাণে প্রোটিন পাওয়া যায়।
এছাড়াও এতে রয়েছে কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন ও খনিজ। বেগুনি আলুতে পাওয়া যায় ম্যাঙ্গানিজ, থিয়ামিন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন সি, ফাইবার, ভিটামিন বি-৬। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির একটি তথ্য বলছে, বেগুনি আলুতে রয়েছে অ্যান্থোসায়ানিন। আলুর এই বেগুনি রং একেবারেই প্রাকৃতিক। ফলের জ্যুস, আইসক্রিম কিংবা রঙিন দইয়ে অনায়াসেই এই রং ব্যবহার করা যায়।
আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির তথ্যে প্রকাশ, বেগুনি আলুর ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা রয়েছে। পার্পল আলুতে থাকে ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড, যা ফাইটোকেমিক্যালের ঘনত্ব কমিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখে রক্তচাপ। তাছাড়া বেগুনি আলু রক্ত জমাট বাঁধা বা থ্রম্বোসিসের ঝুঁকি কমাতে পারে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইটো নিউট্রিয়েন্ট থাকায় নিয়মিত বেগুনি আলু ডায়েটে রাখলে বৃদ্ধি পায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। উপশম হয় ব্যথা যন্ত্রণা। অ্যান্থোসায়ানিন লিভার সুস্থ রাখে। গবেষণা বলছে, বেগুনি আলু হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে দেয় অনেকটাই। পটাশিয়ামের মতো ইলেক্ট্রোলাইট থাকায় অ্যাথলিটরা এই আলু পছন্দ করেন।
অন্যদিকে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণ ফুলকপির তুলনায় কমলা ফুলকপিতে অনেক বেশি পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন থাকে। যা ভিটামিন এ তৈরিতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের জন্য বিশেষ উপকারি। অন্যদিকে, বেগুনি ফুলকপিতে থাকা অ্যান্থোসায়ানিন রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। ফলে হার্টের অসুখের ঝুঁকি কমে অনেকটাই। পুষ্টিবিদ কিংবা উদ্যানপালন গবেষক প্রত্যেকেই লাল বাঁধাকপি ও বেগুনি ফুলকপির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
সাধারণ বাঁধাকপির তুলনায় লাল বাঁধাকপি পুরু ও মচমচে। পাতায় মোমের মতো আবরণ থাকে। ১০০ গ্রাম লাল বাঁধাকপিতে ক্যালোরির পরিমাণ ৩১। কোলেস্টরল নেই। পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ০.১ গ্রাম, মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট শূন্য। সোডিয়াম রয়েছে ২৭ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৪৩ মিলিগ্রাম। শর্করার পরিমাণ ৭ গ্রাম। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব নিউট্রিশনে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা গিয়েছে, বাঁধাকপির জ্যুস স্তন ক্যান্সারের সেল বৃদ্ধি রুখে দেয়। নিয়মিত ওই জ্যুস খেলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমতে পারে ৭২ শতাংশ। প্রস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধেও এটি কার্যকরী। গবেষণা বলছে, যে কোনও বাঁধাকপিতে থাকা আইসোথিয়োকানেটস ও ক্যারোটিনয়েডস উপাদানের ফুসফুসের ক্যান্সার রুখে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তা হলে আর দেরি কেন! আয়ু বাড়াতে আজ থেকেই ডায়েটে যুক্ত হোক লাল বাঁধাকপি কিংবা বেগুনি ফুলকপি।
আমাদের রাজ্যেও ইদানীংকালে বেশকিছু জায়গায় লাল বাঁধাকপির চাষ হচ্ছে। ধীরে ধীরে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি হওয়ায় লাভের মুখ দেখছেন কৃষকরাও। উদ্যানপালন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাল বাঁধাকপি চাষের জন্য আদর্শ দোঁয়াশ মাটি। উপকূল অঞ্চল অর্থাৎ যেখানে লবণাক্ত মাটি, সেখানেও এই ফসলটি চাষ করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, জমিতে যেন জল না দাঁড়ায়। তাহলেই ক্ষতি হবে গাছের। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে লাল বাঁধাকপির চারা বোনার উপযুক্ত সময়।
বীজতলায় বেড করার জন্য খুব ভালো করে জমি তৈরি করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বেডের জন্য মাটির সঙ্গে মেশাতে হবে এক কেজি পচা গোবরসার। এক হেক্টর জমিতে চারা তৈরির জন্য দরকার ২৫০ গ্রাম বীজ। মাটির খুব বেশি গভীরে বীজ পোঁতার প্রয়োজন নেই। বীজতলায় ছাউনির ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো। মূল জমিতে বসানোর জন্য একমাস বয়সি চারা উপযুক্ত। তবে তার আগে জমি ভালোভাবে চাষ দিয়ে নিতে হবে। শেষ চাষের সময় মাটির সঙ্গে মেশাতে হবে গোবরসার। খুব ঘন করে চারা লাগানো উচিত নয়। তাতে পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। কিংবা ছোট হয়ে যেতে পারে কপির আকার। লাল বাঁধাকপি চাষের জন্য জৈবসার প্রয়োগ করাই ভালো। সেক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে গোবরসার বা কম্পোস্ট সার। লাল বাঁধাকপির পাতা অত্যন্ত রসালো হয়। ফলে এই সব্জিটি চাষে জলের দরকার পড়ে। মাটিতে রস আছে কি না তা দেখেই সেচ দিতে হবে। তবে বাড়তি জল যেন বেরিয়ে যায়, জমিতে তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। লাল বাঁধাকপির ক্ষেত্রে ডায়মন্ড ব্ল্যাক মথ পোকা মারাত্মক ক্ষতি করে।
এই পোকা কপির পাতা খেয়ে শেষ করে দেয়। ঝাঁঝরা হয়ে যায় কপি। এই পোকা দমনে ব্যবহার করতে হবে প্রয়োজনীয় কীটনাশক। অনেক সময় কালচে রঙের ল্যাদাপোকা কপি ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ফলে গোটা কপি নষ্ট হয়ে যায়। অনেক পাখি রয়েছে, যারা ল্যাদাপোকা খেয়ে নেয়। তেমন হলে লাল বাঁধাকপির জমিতে যাতে পাখি বসতে পারে, বাঁশের কঞ্চি পুঁতে সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
চারা রোপণের দেড়মাস পর থেকেই লাল বাঁধাকপির মাথা বাঁধা শুরু হয়। আড়াই মাসের মধ্যে কপির মাথা বাঁধা শেষ হয়ে যায়। এর পর কপি তুলতে হবে। এক জায়গা থেকে কপি না তুলে খেতের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফসল সংগ্রহ করা উচিত।
সবুজের সঙ্গে টেক্কা দিতে গেরুয়া ফুলকপিরও চাষ বাড়ছে। বীজ উৎপাদনকারী সংস্থা এই ফুলকপির নাম দিয়েছে ক্যারোটিনা। সাধারণ ফুলকপির তুলনায় এর পুষ্টিগুণ বেশি। চাষে ঝক্কিও কম। রোগপোকার আক্রমণ তুলনামূলক কম হয়। তিন সপ্তাহের মধ্যে তৈরি হয়ে যায় চারা। ফলন পাওয়া যায় তিনমাসেই। বাজারে গেরুয়া ফুলকপি দেখলে অনেকের মনে হতে পারে রং করা। কিন্তু মোটেই তা নয়। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই ফুলকপি একেবারেই নিরাপদ। তাঁদের মতে, প্রাকৃতিকভাবে জিনের পরির্বতন ঘটানোর ফলেই রঙিন হয় ফুলকপি। এর কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই।