দেশের সময়: পুষ্টির দুনিয়ায় মোটেই ব্রাত্য নয় বীজ। বরং হেলদি ডায়েটে রীতিমতো পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে বহু বীজ-ই। ফুলকো লুচির সঙ্গে কুমড়োর ছক্কার যুগলবন্দি কার না পছন্দ! তা বলে কুমড়োর বীজ কিন্তু মোটেই ফেলে দেওয়ার নয়। ঠিক যেমন হেলাফেলার নয় লাল টুকটুকে তরমুজের ভিতরে থাকা বীজগুলো। সূর্যমুখীর বীজ, বেদানার বীজ বা কাঁঠালের দানা বা বীজের কদরও কোনও অংশে কম নয়। আর চিয়া সিড, ফ্লেক্স সিড, বেসিল সিড, হেম্প সিড, এসব তো গুণে ভরপুর। এককথায় সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি।
কিন্তু কী এমন রয়েছে এইসব বীজে!
প্রথমেই আসা যাক চিয়া সিডের কথায়। পুষ্টিবিদরা তো একে সুপারফুডের তকমা দিয়ে দিয়েছেন। বলছেন, সন্ধ্যার জলখাবারে চিয়া সিডের নাকি জুড়ি মেলা ভার। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। রয়েছে প্রয়োজনীয় খনিজ। দেশের বাজারে চিয়া সিডের চাহিদা তুঙ্গে। যদিও এই গাছের জন্ম ভারতে নয়, মেক্সিকোয়। পুষ্টিবিদদের পরামর্শ, চিয়া সিডে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে।
ত্বক ও চুল ভালো রাখে। বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। ফাইবার থাকায় হজম ভালো হয়। শরীর সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। চিয়া সিডে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। যা অবসাদ দূর করে। হার্ট ভালো রাখে। ঘুম ভালো হয়। এছাড়াও এই বীজে রয়েছে প্রোটিন। দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। গর্ভস্থ শিশুর মস্তিস্কের গঠনে চিয়া সিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলেও দাবি করা হচ্ছে গবেষণায়।
হাওড়ার এক নামী হাসপাতালের পুষ্টিবিদ রাখী চট্টোপাধ্যায় বলছেন, চিয়া সিডে দ্রবণীয় ফাইবার থাকায় ওজন নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী এটি। এই ফাইবার দেহে জল ধরে রাখে। যা শরীরকে রি-হাইড্রেট করতে সাহায্য করে। এই বীজে রয়েছে ভিটামিন কে, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ফসফরাস প্রভৃতি। তবে এই সুপার সিডের সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল না খেলে সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে অনেকের অ্যালার্জি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে তবেই আপনার ডায়েটে যোগ করতে হবে এই বীজকে।
এবার দেখা যাক ফ্লেক্স সিড বা তিসি বীজ শরীরকে রোগমুক্ত রাখে কীভাবে।আসলে প্রকৃতির ভান্ডারে কত যে মহৌষধি লুকিয়ে রয়েছে, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। প্রাচীনকাল থেকেই শরীর সুস্থ রাখতে তিসি বীজের ব্যবহার হয়ে আসছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এক চামচ ফ্লেক্স সিডে রয়েছে প্রায় ১.৩ গ্রাম প্রোটিন, ২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১৯ গ্রাম ফাইবার, ১.৫৯৭ এমজি ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, দৈনিক চাহিদার ৮ শতাংশ ভিটামিন বি-১, ফলেট ২ শতাংশ, ২ শতাংশ আয়রন, ৭ শতাংশ ম্যাগনেশিয়াম, ২ শতাংশ ক্যালসিয়াম, ৪ শতাংশ ফসফরাস ও ২ শতাংশ পটাশিয়াম। শরীরকে সুস্থ রাখতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের তুলনা হয় না।
মানসিক চাপ ও উদ্বেগ দূর করার পাশাপাশি দৃষ্টিশক্তির উন্নতি ঘটাতে ও মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতে, হার্ট সুস্থ রাখতে ও শরীরে প্রদাহের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।ফ্লেক্স সিড থেকে যথেষ্ট পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। কিছু গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ফ্লেক্স সিড থেকে পাওয়া ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের কারণে অটোইমিউন ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায় অনেকটাই। কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে প্রায় ৫৫ শতাংশ। মিশরে প্রথম পাওয়া গেলেও ফ্লেক্স সিড আজ গোটা বিশ্বে সমাদৃত।
পুষ্টিবিদ রাখীর কথায়, এই বীজে ফাইবার থাকায় কনস্টিপেশন দূর করে। ফাইবারের জন্যই এর স্যাটাইটি ভ্যালু বেশ বেশি। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণ করে। রক্তে খারাপ কোলেস্টরলের মাত্রা কমায়। ফ্লেক্স সিডের মধ্যে অ্যান্টি ক্যান্সার উপাদান যেমন লিগন্যান রয়েছে। এটি ব্রেস্ট ক্যান্সারের আশঙ্কাকে কমিয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ফ্লেক্স সিড ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বৃদ্ধি করে। তবে সঠিকমাত্রায় গ্রহণ না করলে বিপদ হতে পারে। আনরোস্টেড ফ্লেক্স সিডে বেশ কিছু টক্সিন থাকে। যা হজমের গোলমাল ডেকে আনে। এছাড়া এই বীজের সঙ্গে পর্যাপ্ত জল না খেলে ডায়ারিয়া হতে পারে।
সন্তানসম্ভবাদের এই বীজ না খাওয়া ভালো। সার্জারির আগে ফ্লেক্স সিড খাওয়া বন্ধ করা দরকার। কারণ, এটি রক্ত তঞ্চন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
শরীরে বাড়তি মেদ সমস্যা। রোজ সকালে ঈষদোষ্ণ জলে পাতিলেবু আর মধু খেয়েও কোনও ফল হচ্ছে না। এই সমস্যা সমাধানে পুষ্টিবিদরা একটি বীজের সন্ধান দিচ্ছেন। আর তা হল বেসিল সিড কিংবা মিষ্টি বেসিল দানা। তবে এর সঙ্গে চেনা তুলসি গাছের কোনও সম্পর্ক নেই। এই বীজে রয়েছে লো-কার্বের সঙ্গে হাই প্রোটিন।
যাকে বলে একেবারে যোগ্য সঙ্গত। অল্পতেই পেট ভরে যাবে। খিদেও পাবে না অনেকক্ষণ। মিষ্টি বেসিলের দানা জলে ভিজিয়ে রাখলেই আকারে বেড়ে যায়। সেইসঙ্গে বাড়তে থাকে এর পুষ্টিগুণ। দইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। ওজন কমানোর সঙ্গেই ব্লাড সুগার, হজমশক্তি বৃদ্ধির কাজও করে। সপ্তাহে দু’দিন খালি পেটে খেলেই যথেষ্ট। চীনে প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বেসিল সিডের ব্যবহার হয়ে আসছে। দেখতে অনেকটা চিয়া সিডের মতো।
অনেক সময় এই বীজ কুলপি আইসক্রিম ও কেকে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ভালো পরিমাণে রয়েছে ভিটামিন কে ও আয়রন। নিয়মিত গ্রহণে ত্বক থেকে অধিক পরিমাণে কোলাজেন নিঃসৃত হয়। যা ত্বক ও চুলের জন্য উপকারি। এতে রয়েছে ভিসেনিন, অরিয়েন্টিন ও বিটা ক্যারোটিনের মতো কিছু ফ্লাভোনয়েড। যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
হেম্প সিড। এটিও একটি সুপার ফুড। এতে রয়েছে এসেনশিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিড। অ্যাসিড সহযোগে ভালো মানের প্রোটিন। রয়েছে সঠিক অনুপাতে ওমেগা থ্রি এবং ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড। উপস্থিত ফাইবারের পরিমাণও বেশি। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন ই, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক, ফসফরাস ও সঠিক মাত্রায় পটাশিয়ামও পাওয়া যায়। অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটারি ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ধর্ম রয়েছে এর। নিউরো প্রোটেক্টিভ যৌগ ক্যানাবিডিওল এর উপস্থিতিতে বিভিন্ন নিউরো সমস্যা দূর হয়। এই বীজের তেল বাতের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।
কুমড়োর বীজ সাদামাঠা হলেও উপকারিতা অনেক। এতে রয়েছে ফাইবার, প্রোটিন, ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিডের সঙ্গে ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক ও কপার। ভিটামিন বি-২ ও ফলেট পুষ্টিগুণে একে সমৃদ্ধ করেছে। তরমুজের বীজকে তো পুষ্টির আধার বলা হয়। এতেও রয়েছে প্রচুর জিঙ্ক, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ফলেট, কপার। যা ইমিউনিটি বৃদ্ধি করে। প্রতিরোধ করে হাইপারটেনশন। কপার, ম্যাঙ্গানিজ ও পটাশিয়াম অন্যান্য খনিজের সঙ্গে মিলে হাড়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। বাড়ায় হজমশক্তিও।