দেশের সময়: ব্রয়লার মুরগির মাংস খেতে খেতে মুখে অরুচি ধরে গিয়েছে! জিভের স্বাদ একটু বদলাতে পরখ করে দেখা যেতেই পারে টার্কির মাংস।
এই মাংসের এমনই গুণ যে, রোগব্যাধি থেকে রক্ষা করবে আপনার শরীরকে। ধারে কাছে ঘেঁষবে না কোলেস্টেরল। শরীর ও মন থাকবে শান্ত। ঘুম হবে ভালো।
এমনকী, টার্কির মাংস নিয়মিত খেলে ঝুঁকি কমতে পারে ফুসফুস, চামড়া, প্রস্টেট, গ্যাস্ট্রিক, কোলন ক্যান্সারের। বাড়বে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এমনটাই বলছেন পুষ্টিবিদরা।
শুধুমাত্র রোস্ট নয়। টার্কি কষা, কাবাব কিংবা ঝোলেও মন্দ লাগে না। মূলত শীত এলেই টার্কি প্রীতি বাড়ে। এতদিন বড়দিন কিংবা ইংরেজি নববর্ষে সাহেবি পদের তালিকায় ছিল এই মাংস। রসনা বদল করতে কলকাতার বাঙালিরা ভিড় জমাতেন শহরের ফ্রি স্কুল স্ট্রিট বা পার্ক স্ট্রিটের রেস্তরাঁয়।তবে সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ছবিটা। স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে সারা বছর ধরেই এখন টার্কির মাংসের চাহিদা থাকে।
টার্কির মাংসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে লিন প্রোটিন। আর ওজন কমানোর জন্য হোক কিংবা হার্ট সুস্থ রাখতে, পুষ্টিবিদরা জোর দেন লিন মিটের উপর। রেড মিটের বদলে হেলদি প্রোটিন হিসেবে লিন মিটকে বেছে নিতে বলছেন তাঁরা। লিন মিটে ফ্যাট ও ক্যালোরির পরিমাণ অনেক কম থাকে। অথচ রেড মিটের মতোই থাকে প্রোটিনের মাত্রা।
ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের তথ্য বলছে, একশো গ্রাম টার্কির মাংসে এনার্জি রয়েছে ১৭০ ক্যালোরি, মোট ফ্যাট ৮ গ্রাম, স্যাচুরেটেড ফ্যাট আড়াই গ্রাম, ট্রান্স ফ্যাট শূন্য, প্রোটিন ২৪ গ্রাম, কোলেস্টরল ৭০ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৫৫ মিলিগ্রাম, সেলেনিয়াম ৩৮.৪৫ এমসিজি, আয়রন ৮ শতাংশ। ১৬৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় টার্কির মাংস রান্না করা উচিত। রান্নার আগে মাংসের ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া দরকার। এতে ফ্যাটের পরিমাণ অনেকটা কমে যায়। টার্কির সাদা মাংসের তুলনায় কালচে মাংসে ভিটামিন ও মিনারেলের পরিমাণ বেশি থাকে।
পুষ্টিবিদদের মতে, অন্য মাংসের তুলনায় টার্কির মাংসে বেশি রয়েছে অ্যামাইনো অ্যাসিড ট্রিপটোফেন। শরীরে সেরোটনিনের উপযুক্ত স্তর বজায় রাখতে সাহায্য করে ট্রিপটোফেন। যা মন ভালো রাখার কাজে সহায়ক হয়। এছাড়াও টার্কির মাংসে মিনারেল হিসেবে রয়েছে সেলেনিয়াম। গবেষণা বলছে, নিয়মিত খাবারের মাধ্যমে সেলেনিয়াম গ্রহণ করলে একাধিক ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। সেলেনিয়াম আমাদের শরীরে অল্প পরিমাণে লাগে। কিন্তু এর কাজ অনেক বড়। থাইরয়েড ও বিপাক ক্রিয়ায় সেলেনিয়ামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটি শরীরে শক্তিশালী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফ্রি র্যাডিক্যালস-এর কারণে আমাদের শরীরে কোষের যে ক্ষতি হয় তা রুখে দিতে পারে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। টার্কির মাংসে ভিটামিন-ই অনেক বেশি থাকে। রয়েছে ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন বি-১২, জিঙ্ক, নিয়াসিন।
অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্থ-এর প্রাণ রসায়ণ ও পুষ্টি বিভাগের এক প্রাক্তন কর্তা বলেছেন, চিকেনের তুলনায় টার্কিতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড পাঁচগুণ বেশি। ফলে হার্টের জন্য খুব ভালো। চিকেনে যেখানে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ ২২.৫২, টার্কিতে সেখানে এই পরিমাণ ১৩১। এছাড়া খুব কম খাবার লিনোলেনিক অ্যাসিডের উৎস। সেদিক থেকে টার্কি এগিয়ে রয়েছে। সব মিলিয়ে টার্কির মাংসে পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি থাকায় হৃদরোগ ঠেকাতে এই মাংস উপকারি হতে পারে। চিকেনে পুফা কনটেন্ট ৫২০, টার্কিতে ১০৩৫। সেইসঙ্গে টার্কিতে ট্রিপটোফেনের পরিমাণ ১.৬২। যেখানে চিকেনে রয়েছে ১.২০। ট্রিপটোফেন হ্যাপি হরমোন সেরোটনিন নিঃসরণে সহায়তা করে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি টার্কির মাংস উৎপাদন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার অধিবাসীরা থ্যাঙ্কস গিভিং ডে-র ছুটির দিনে টার্কির মাংস খেয়ে থাকেন। ইউরোপীয় দেশগুলিতে বিশেষ খ্রীষ্টিয় পর্বের আহারে এই মাংস খাওয়া হয়ে থাকে। টার্কি উৎপাদন মূলত ঋতু ভিত্তিক হলেও সারা বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি খাবারের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে।
জানা যায়, ইউরোপীয়রা যখন প্রথমবারের জন্য টার্কিকে আমেরিকায় দেখতে পেলেন, তখন তাঁরা ভাবলেন যে, পাখিটি এক ধরনের গিনিয়া মুরগি। পরবর্তীতে তাঁরা তুরস্ক থেকে মধ্য ইউরোপে পাখিটিকে নিয়ে আসেন। গিনিয়া মুরগি বা গিনিয়া ফাউলকে টার্কি ফাউল নামেও ডাকা হয়। তুরস্ক দেশের নামানুসারে উত্তর আমেরিকায় পাখিটির নামকরণ করা হয় টার্কি। ১৫৫০ সালে উইলিয়াম স্ট্রিকল্যান্ড নামে এক ইংরেজ নাবিক টার্কিকে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্র মোতাবেক, ক্যালিফোর্নিয়া টার্কি মেলিয়াগ্রিস ক্যালিফোর্নিকা মানব জাতির বসতির শুরুতে যথেষ্ট সংখ্যায় শিকারে পরিণত হয়েছিল। ধারণা করা হয়, তুষার যুগের শেষ দিকে জলবায়ুর পরিবর্তন ও ব্যাপক শিকারের ফলে এই প্রজাতির টার্কির বিলুপ্তি ঘটেছিল।
প্রাণীবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সম পরিমাণ মুরগির মাংসের তুলনায় টার্কির মাংসে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি। এছাড়া স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে। সেজন্য যাঁরা স্বাস্থ্য সচেতন, তাঁদের জন্য টার্কির মাংস বিকল্প হতে পারে। বিশেষ করে যাঁরা অনিদ্রা রোগে ভুগছেন, তাঁদের এই মাংস খেলে উপকার হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ফার্মে পালিত টার্কির তুলনায় মুক্তাঙ্গনে পালিত টার্কির মাংসে প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি থাকে। যা মাংসের পুষ্টিগুণ বাড়িয়ে তোলে।
প্রাণী বিজ্ঞানীরা বলছেন, টার্কির আদি নিবাস মেক্সিকো। বিজ্ঞানসম্মত নাম মেলিয়াগ্রিস গ্যালোপাভো।
৫-১১ কেজি ওজন হয়। চর্বি কম ও প্রোটিন বেশি থাকায় খাসির মাংসের বিকল্প হতে পারে। মানব শরীরের জন্য উপকারি লোহা, জিঙ্ক, পটাশিয়াম, ফসফরাস অনেক বেশি পরিমাণে থাকে এই মাংসে। এ রাজ্যে প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নিগমের হরিণঘাটা মিট-এর বিপণন কেন্দ্রগুলিতে টার্কির মাংস পাওয়া যায়। টার্কির মাংস সহজে হজম হয়। এই মাংসের ৭০-৮০ শতাংশ খাওয়ার যোগ্য। মাংসের মতোই টার্কির ডিমও পুষ্টিগুণে ভরপুর। শিশু ও বয়স্কদের জন্য টার্কির মাংস বিশেষ উপকারি। ৩০ সপ্তাহ বয়সে ডিম দেওয়া শুরু করে টার্কি। ২৪ সপ্তাহ ধরে ডিম দেয়। বছরে ৮০-১০০টি ডিম দিতে পারে। প্রতিটি ডিমের গড় ওজন হয় ৬০-৬৫ গ্রাম।
রাজ্য প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহ অধিকর্তা বলছেন, টার্কির মাংস ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়। এছাড়া এই মাংসের ফ্যাটে পিইউএফএ অর্থাৎ পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ অনেকটাই বেশি থাকে। পিইউএফএ হার্ট ভালো রাখতে সাহায্য করে। টার্কির মাংসে অ্যামাইনো অ্যাসিড ট্রিপটোফান রয়েছে। যা সেরোটনিন নিঃসরণে সহায়তা করে। এর ফলে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। ১০০ গ্রাম টার্কির মাংসে পিইউএফএ-র পরিমাণ ৪.৪ শতাংশ। টার্কির মাংসে উচ্চমাত্রায় সেলেনিয়াম রয়েছে। যা থাইরয়েড হরমোন সংশ্লেষে আবশ্যিক। এটি লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ফুড অর্থাৎ টার্কির মাংস খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ে না।
অলটারনেটিভ মেডিসিন নিয়ে কাজ করা এক চিকিৎসকের কথায়, আমরা রোগীদের কোয়েল, টার্কির মাংস খেতে বলি। ব্রয়লার মুরগিকে হরমোন ইঞ্জেকশন দিয়ে অস্বাভাবিক হারে ওজন বাড়ানো হয়। যা মোটেই ঠিক নয়। অর্গানিক খামারে টার্কি পালন করতে পারলে গুণাগুন অনেকটাই বেড়ে যায়।
তা হলে আর কী!
এবার টার্কির প্রেমে মজে ওঠা যাক। সুবিধা দু’টো। মুখের রুচি বদলাবে। আবার দূরে থাকবে রোগবালাই।