দেশের সময়: মায়ের পায়ের জবা হয়ে…।’
না, শুধু মায়ের পুজোতেই যে জবা ফুল দরকার হয় তা নয়। শরীর ফিট রাখতেও এর জুড়ি নেই। লাল টকটকে জবার মধ্যে রয়েছে এমনই গুণ যা রোগমুক্তি ঘটাতে রীতিমতো অব্যর্থ।
শুনে নিশ্চয়ই ভ্রু কুঁচকাচ্ছেন। ভাবছেন, সে আবার কেমন হবে! বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বাদে দার্জিলিং কিংবা অসমের চা-কে টেক্কা দিতে পারুক আর না পারুক, গুণের নিরিখে সে রীতিমতো লেটার মার্কস নিয়েই পাশ করবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এমনই জাদু জবার।
নিয়মিত জবা ফুলের চা (হিবিস্কাস টি) খেলে হাজারো রোগ থেকে দূরে থাকা যাবে, বলছেন উদ্যানপালন বিজ্ঞানী থেকে চিকিৎসকরা। তাঁদের দাবি, জবা গাছের বিভিন্ন অংশ যেমন ফুল, পাতা, কাণ্ড এমনকী শিকড়েরও বিশেষ গুণ রয়েছে। যা মানব শরীরের জন্য দারুণভাবে উপকারি। সেসব নিয়ে রীতিমতো গবেষণাও চলছে দেশে-বিদেশে।
করোনা পরিস্থিতিতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অনেকেই হার্বাল টি বা ভেষজ চায়ের দিকে ঝুঁকেছেন। কেউ কেউ আবার আগে থেকেই ভেষজ চা পান করেন। এক্ষেত্রে জবা ফুলের চা তাঁরা বেছে নিতেই পারেন, বলছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি, জবা ফুলের চা খেতে মোটেই খারাপ নয়। তাছাড়া এটি স্বাস্থ্যসম্মত। নিয়মিত হিবিস্কাস টি খেলে উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণে থাকে। লিভারের রোগ প্রতিরোধেও এটি দারুণ কার্যকরী। এর মধ্যে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ক্যান্সারের প্রবণতা কমাতে সাহায্য করে। দূর করে উদ্বেগ। হজমের সমস্যাও উধাও হয়ে যায় কয়েকদিনেই। ভালোমাত্রায় ভিটামিন সি, মিনারেলও পাওয়া যায় জবা ফুলে।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের দাবি, জবা ফুল কিংবা জবা পাতার বহু গুণাগুন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আয়ুর্বেদে এসবের ব্যবহার হয়ে আসছে। জবা ফুলের চা পান করার রেওয়াজ সেভাবে এতদিন ছিল না। এখন নানা গবেষণা হচ্ছে। তবে এটা বলা যেতেই পারে, জবা ফুলের চা উপকার ছাড়া অপকার করবে না।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের কথায়, জবা ফুল থেকে তৈরি হোমিওপ্যাথি ওষুধ রয়েছে। যা জরায়ু, মিউকাস মেমব্রেন, স্নায়ু, হজমের সমস্যায় ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও অ্যানিমিয়া, গ্লুকোমা, নিউরো মাইলাইটিস, পক্ষাঘাত, চোখের সমস্যা সহ নানা রোগে খুব ভালো কার্যকরী।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জবা ফুল অত্যন্ত সহজলভ্য। সব জায়গাতেই এটি পাওয়া যায়। তাছাড়া শহরে ফ্ল্যাট কালচারের যুগে অনেকেই ব্যালকনিতে টবে জবা গাছ লাগিয়ে থাকেন। ফলে জবা ফুলের পাপড়ি জলে ফুটিয়ে মধু মিশিয়ে চা তৈরি করে খাওয়া কোনও সমস্যাই নয়। নিয়ম করে কিছুদিন এই পানীয় খেলেই গুণাগুন টের পাওয়া যাবে বলে দাবি তাঁদের।
এর আগে চায়ের বিশাল সাম্রাজ্যে যুক্ত হয়ে গিয়েছে জুট টি। পাট পাতা থেকে তৈরি ভেষজ চা রুখে দিতে পারে ক্যান্সার! এমনটাই দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। এমনকী, পাট পাতার চা সুগার, কোলেস্টরল, উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ম্যাজিকের মতো কাজ করবে, বলছেন গবেষকরা। পাট পাতার চা তৈরি করে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। নিজের দেশে তৈরি ওই নয়া চা পান করে তারিফ করেছেন খোদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর উদ্যোগেই পাট পাতা থেকে চা তৈরি শুরু করে দিয়েছে পদ্মাপাড়ের দেশ। বাংলাদেশের কাছ থেকে পাট পাতার চা কিনছে জার্মানি। জুট টি’র মধ্যে দিয়েই আগামী দিনে বাংলাদেশকে নতুন করে চিনবে গোটা বিশ্ব, এমনটাই দাবি ওপার বাংলার বিজ্ঞানীদের। বসে নেই আমাদের রাজ্যের বিজ্ঞানীরাও। পাট পাতার চা নিয়ে তাঁরাও নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু কী রয়েছে পাট পাতায় যে, এর থেকে তৈরি চা রোগমুক্তি ঘটাতে পারে? গবেষণা বলছে, পাট পাতায় রয়েছে মিনারেল, ভিটামিন, প্রোটিন, ফসফরাস, ফ্যাট ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। রয়েছে পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, ফাইবার, ভিটামিন এ, সি এবং ই। থাকে রাইবোফ্লাবিন, নিয়াসিন এমনকী ফোলেট। পাট পাতায় থাকা ওমেগা-৩ রক্তচাপ ও কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ফলে ঝুঁকি কমে হার্টের অসুখের। তাছাড়া ওমেগা-৩ প্রদাহ রোধ করে। বাতের ব্যথা কমায়। হাঁপানি ও ফুসফুসের প্রদাহ কমাতেও সাহায্য করবে পাট পাতার চা। নিয়মিত ওই চা পান করলে মসৃণ হবে ত্বক। বাড়বে ঔজ্জ্বল্য। পাটের পাতায় থাকা ভিটামিন এ এবং ই বয়সের ছাপ পড়তে দেবে না। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় প্রতিরোধ করা যাবে ক্যান্সার।
জবা ফুল কিংবা পাট পাতা থেকে চা নিয়ে গবেষণা সামনে আসতেই রীতিমতো আলোড়ন তৈরি হয়েছে। অনেকে চুলের যত্নে জবা ফুল ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু জবা ফুল খাওয়ার কথা আমরা সাধারণভাবে ভাবি না। ফলে অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন, যে কোনও জবা ফুলের পাপড়ি দিয়েই কি চা তৈরি করে খাওয়া যেতে পারে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, সব জবা ফুলেরই গুণাগুন কমবেশি একই। তবে চা তৈরি করে খাওয়ার জন্য রক্তজবা বেছে নেওয়া উচিত। এর রং হবে চুনির মতো লাল। খেতে কিছুটা টক। এ কারণে অনেকে একে টক চা বলে থাকেন। কারও মতে, জবা ফুলের চায়ের স্বাদ যেন অনেকটা ক্র্যানবেরি জুসের মতো। যেমন খুশি সেভাবে বানিয়ে খাওয়া যায়। ক্যাফিন থাকে না। ফলে শরীরে কোনও খারাপ প্রভাব পড়ে না। তা বলে দিনে যতবার খুশি খাওয়া যেতে পারে জবা ফুলের চা? চিকিৎসকরা বলছেন, মোটেই তা নয়। দিনে খুব বেশি হলে দুই থেকে তিনকাপ এই চা খাওয়া যেতে পারে।
ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে শরীরে উপকার করতে পারে হিবিস্কাস টি? বিজ্ঞানীদের দাবি, এই চা শরীরে হরমোন ব্যালান্সে সাহায্য করে। অবসাদ কাটায়। ভাত-রুটি কিংবা কোনও খাবার অনেকটা খাওয়ার পর শরীরে হাসফাঁস অবস্থা তৈরি হলে এই চা দ্রুত স্বস্তি দেয়। বেশি পরিমাণে কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার খেলে শরীরে স্টার্চ জমা হতে থাকে। বৃদ্ধি পায় গ্লুকোজের পরিমাণ। জবা ফুলের চায়ের সেই স্টার্চ ও গ্লুকোজ শুষে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। ফলে শরীরে মেদ জমে না। স্বাদ বৃদ্ধির জন্য জবা ফুলের চায়ের সঙ্গে মধু কিংবা সামান্য চিনি, এলাচ, লবঙ্গ, আদা বা লেবুর রস মেশানো যেতে পারে।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা বলছেন, প্রথমে আট থেকে দশটা লাল জবার পাপড়ি সংগ্রহ করতে হবে। তার পর ফেলে দিতে হবে ফুলের মাঝের ডাঁটি। এবার গরম জলে মিনিট দশেক ফোটাতে হবে। এই সময় যোগ করা যেতে পারে এলাচ বা দারুচিনি। জল ফুটতে শুরু করলেই বদলে যাবে রং। ইচ্ছেমতো মধু কিংবা চিনি মেশানো যেতে পারে। ঠান্ডা বা গরম যে কোনওভাবেই খাওয়া যেতে পারে এই পানীয়। তবে চিকিৎসকদের দাবি, এটি মূলত রোগ প্রতিরোধক হিসেবেই ব্যবহার করা যেতে পারে। জবা ফুলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সক্ষম। রক্তে জমে থাকা টক্সিন বের করে দেয়। কিন্তু শরীরে ক্যান্সার থাবা বসিয়ে ফেললে তার বৃদ্ধি ঠেকাতে এই পানীয় আদৌও সাহায্য করছে কি না, তার কোনও প্রমাণ এখনও হাতে নেই।
তবে, জবা ফুলের চা খাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে কিছু বিধিনিষেধও। এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বাদের এই চা না খাওয়াই ভালো। যাঁরা হরমোনের চিকিৎসা করাচ্ছেন, তাঁদেরকেও হিবিস্কাস টি খাওয়ার আগে অনুমতি নিতে হবে ডাক্তারবাবুর। জবা ফুলের চা যেহেতু উচ্চ রক্তচাপ দ্রুত কমিয়ে দেয়, ফলে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন,জবা ফুলের চা খেলে অনেকের ক্ষেত্রে ঘোর লাগার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ফলে শরীরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে তা দেখে তবেই এই পানীয় রাখতে হবে পছন্দের তালিকায়। যাঁদের নিম্ন রক্তচাপ, তাঁরা জবা ফুলের চা খেলে বুক ধড়ফড় করতে পারে। মাথা ঘোরা কিংবা লাগতে পারে বমিভাব। জবা ফুলে অ্যালুমিনিয়াম থাকে। ফলে যাঁদের কিডনির সমস্যা রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অ্যালুমিনিয়াম জমা হলে সমস্যা হতে পারে। এই চা খেলে কারও কারও অ্যালার্জিও হতে পারে, দেখে নিতে হবে সেটাও।
প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ওষুধ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে জবা ফুলের। তবে এতদিন সাধারণভাবে চুলের যত্নে সীমাবদ্ধ ছিল জবা ফুলের পাপড়ি কিংবা পাতার রসের ব্যবহার। চুল ঘন, কালো করার জন্য অনেকেই ব্যবহার করে থাকেন এই টোটকা। চুলের বৃদ্ধি, খুসকি দূর করা, ঝলমলে চুলের জন্য জবা ফুলের তেল খুবই উপকারি। ক্লিনজিং ন্যাচারাল শ্যাম্পু তৈরি করতেও লাগে জবা ফুল। সহজেই বানিয়ে ফেলা যায় বাড়িতে। এর সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে অলিভ অয়েল, মধু, ল্যাভেন্ডার এসেন্সিয়াল অয়েলও।
কেউ কেউ আবার ত্বকের যত্নে জবা ফুলের রস মেখে থাকেন। এটি কাজ করে ন্যাচারাল টোনার হিসেবে। যা ত্বকের বাড়তি তেল নিয়ন্ত্রণ করে। ত্বকের প্রদাহ কমাতেও সাহায্য করে। অ্যান্টি এজিং হিসেবেও ব্যবহার হয় জবা ফুল। এর মধ্যে থাকা বোটক্স প্রপার্টি মুখের ত্বককে টানটান করে রাখে। স্কিনের বয়স কমিয়ে দেয়। যাঁরা মুখের দাগছোপের সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের জন্যও এটি ভীষণ উপকারি।
জবা ফুলের মধ্যে থাকা সাইট্রিক ও ম্যালিক অ্যাসিড মুখের কালো দাগ উধাও করে দিতে পারে। নারকেল তেল কিংবা তিল তেলের সঙ্গে জবা ফুলের রস মিশিয়ে ব্যবহার করলে রেহাই পাওয়া যায় শুস্ক ব্রণ থেকেও। এটি ফেসপ্যাক হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। গবেষণা বলছে, রূপচর্চা থেকে স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা—সবেতেই সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে জবা ফুল।