অর্পিতা বনিক, গোবরডাঙা: নাটক সমাজের দর্পন। ঘুন ধরা সমাজকে সঠিক দিশা দেখাতে পারে একমাত্র থিয়েটার। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আজ, শনিবার থেকে নকশা নাট্যগোষ্ঠীর উদ্যোগে গোবরডাঙায় শুরু হলো আন্তর্জাতিক থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল। দেখুনভিডিওNational Theater Festival begins in Gobardanga, plays from Kashmir, theater from the US: watch video

এবারের নাট্য উৎসবে মোট ১২টি নাটকের তেরোটি শো পরিবেশিত হবে। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকছে বাংলাদেশের নাটক। আবার জম্মু ও কাশ্মীর থেকেও একটি নাটক আসছে। পাশাপাশি মার্কিন মুলুকের নাটকও আসছে। সেখানকার প্রবাসী বাঙালিরা বাংলা নাটক পরিবেশন করবেন।

রাজ্যের পরিচিত নাট্যগোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্যতম নকশা। এই নাট্যসংস্থার বয়স ৪৩ বছর। তাদের উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় নাট্য উৎসব এবার দশ বছরে পা রাখল। নকশার অন্যতম কর্ণধার আশিস দাস জানিয়েছেন, মফস্বল শহর গোবরডাঙা বরাবর সংস্কৃতি মনস্ক। বহু বছর ধরে এখানে বিভিন্ন সংস্থা ধারাবাহিকভাবে থিয়েটার চর্চা করে চলেছে। রাজ্যে তো বটেই, গোটা দেশেও এমন কোনও শহর নেই, যেখানে এত ছোট জায়গায় এতগুলি নাটকের দল। সেকারণেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, গোবরডাঙার নাট্যপ্রেমী মানুষ যাতে নিজেদের এলাকায় বসেই গোটা দেশের নাটক দেখার সুযোগ পান।

শুধু দেশ কেন, বিদেশের নাটকও যাতে গোবরডাঙার বুকে মঞ্চস্থ হয়, সেই প্রচেষ্টা থেকেই এই জাতীয় নাট্য উৎসবের সূচনা। প্রথম থেকেই বিপুল সাড়া পড়েছে এই নাট্য উৎসবে। এবার পুরোপুরি অন্যরমকভাবে নাট্য উৎসবকে সাজানো হয়েছে। যাঁরা নিয়মিত নাটক দেখেন বা থিয়েটার নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের রাজ্যের নামী নাটকের দলগুলিকে জানেন। তাদের নাটকও দেখেছেন। সেকারণে আমরা এবার চেয়েছি, যাঁরা আমাদের রাজ্যে ও রাজ্যের বাইরে খুব ভাল নাটক করছেন, কিন্তু তাঁদের দল এখনও সেভাবে প্রচার পায়নি, আমরা অনেকেই তাদের জানি না, তাঁদেরকে জাতীয় নাট্য উৎসবের প্ল্যাটফর্মে সুযোগ দেওয়ার।

সেইমতো আমরা এবার একটি ঘোষণা রেখেছিলাম যে, যাঁরা ভাল কাজ করছেন বলে মনে করেন, তাঁরা আমাদের এই জাতীয় নাট্য উৎসবে অংশগ্রহণ করতে চাইলে আবেদন করতে পারেন। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিপুল সাড়া পেয়েছি আমরা। একশোটিরও বেশি নাটকের দল আবেদন করে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা সেই আবেদনের মধ্যে থেকে পাঁচ-ছ’টি নাটককে বেছে নিয়েছেন। তাঁদের নাটক দেখার জন্য নাট্যপ্রেমীরা মুখিয়ে রয়েছেন। আমরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

আশিসবাবুর আক্ষেপ, আগে নাট্যকর্মীরা ট্রেনের ভাড়ায় ছাড় পেতেন। কিন্তু এখন সেই ছাড় তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে দূরে কোথাও গিয়ে নাটক উপস্থাপন করা মফস্বলের দলগুলির কাছে একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, একটি নাটকের টিমে অনেকে থাকেন। সবমিলিয়ে মোটা টাকা ট্রেনভাড়া চলে যায়। ফলে সামর্থ্যে কুলোয় না। আর মফস্বলের নাটকের টিমকে কারাই বা স্পনসর করবে। শুধুমাত্র এই কারণে এবারের নাট্য উৎসবে ভিন রাজ্যের অনেক দলকে আনা যায়নি বলে দাবি তাঁর।

শুধু নাটক নয়, গোবরডাঙা সংস্কৃতি কেন্দ্রে দশদিন ধরে চলা জাতীয় নাট্য উৎসবের মুক্ত মঞ্চে থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে যেমন গান গাইতে আসছে লালন অ্যাকাডেমি। আবার লোকগান পরিবেশন করতে আসছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী শুভদীপ গুহ। পার্বতী বাউলের সঙ্গে যিনি ফিউশন বাজান, সেই নীলাংশু দত্ত হাজির থাকছেন। মিরাক্কেল খ্যাত তন্ময় অধিকারী আসছেন। গোবরডাঙা পুরসভার পুরপ্রধান শস্কর দত্ত নাট্য উৎসবের উদ্বোধন করবেন। সঙ্গে থাকবেন স্থানীয় কাউন্সিলর বাসুদেব কুণ্ডু। বিশিষ্ট অভিনেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। নাট্যশিল্পী অর্পিতা ঘোষ, পিয়াল ভট্টাচার্যের মতো ব্যক্তিত্ব। নকশার তরফে জানানো হয়েছে, যাঁরা সারাবছর নাটক দেখেন, তাঁদের জন্য পাঁচশো টাকার বাৎসরিক চাঁদা নেওয়া হয়ে থাকে। এতে তাঁরা বছরভর নকশার যতগুলি নাটক পরিবেশিত হয়, তা দেখার সুযোগ পান তাঁরা। সঙ্গে জাতীয় নাট্য উৎসবে সবক’টি নাটক দেখার সুযোগ মেলে। কিন্তু যাঁরা শুধুমাত্র নাট্য উৎসবে একটি নাটক দেখবেন বলে মনস্থির করেছেন, তাঁদের জন্য টিকিটের মূল্য রাখা হয়েছে একশো টাকা। 

গোবরডাঙায় নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য একটি ভাল প্রেক্ষাগৃহের অভাব ছিল অতীতে। এনিয়ে নাটকের দলগুলি অনেক আন্দোলনও করেছে। আশিস দাসের কথায়, এটা ঠিক যে, গোবরডাঙা টাউন হলটি যখন সংস্কারের অভাবে বেহাল হয়ে পড়ে, তখন নাটক মঞ্চস্থ করার মতো কোনও জায়গা ছিল না আমাদের শহরে। কিন্তু শুধুমাত্র প্রেক্ষাগৃহের জন্য যে থিয়েটার থেমে থাকতে পারে না, সেটা আমরা প্রমাণ করেছি। যেখানে ফাঁকা জায়গা পাওয়া গিয়েছে, স্টেশনে, মাঠে, কারও বাড়ির বারান্দায় আমরা নাটকের রিহার্সল করেছি। নাটক মঞ্চস্থ করেছি। সেই লড়াইয়ে জয় হয়েছে। এখন গোবরডাঙায় নাটকের দলগুলির নিজস্ব স্টুডিও হয়েছে। টাউনহলেরও চেহারা বদলেছে। শুধু নাট্য উৎসবের সময়ই যে এখানে থিয়েটার নিয়ে কথা হয় তা নয়। সারা বছর ধরেই গোবরডাঙায় নাটকের চর্চা চলে। 

নকশার তরফে জানানো হয়েছে, নকশার নিজস্ব নাটক ‘চিত্রাঙ্গদা’ দিয়ে শুরু হবে এবারের নাট্য উৎসব। নাটকটির নির্দেশনায় রয়েছেন ভূমিসূতা দাস। এই নাটকটি ফের পরদিন দেখানো হবে। ১৯ ডিসেম্বর থাকছে মণিপুরের নাটক চেইথেং (অ্যাগনি)। নির্দেশনায় ড. ইয়মনাম সদানন্দ সিং। ওই দিনই থাকছে নকশার নাটক ছোট ছোট বড়রা। নির্দেশনায় দেবাশিস। ২০ তারিখ মঞ্চস্থ হবে বিদূষক নাট্যমণ্ডলীর নাটক কেন পল্টু জোরে ছোটে। রাজা বিশ্বাসের এই নাটকটির নির্দেশনায় রয়েছেন অমিত সাহা। ২১ তারিখ মঞ্চস্থ হবে নকশার নাটক ইয়েস।নির্দেশনায় ভূমিসূতা দাস।

ওই দিন থাকছে নকশার আরও একটি নাটক হুলো। মৈনাক সেনগুপ্তের এই নাটকের নির্দেশনায় রয়েছেন আশিস দাস। ২২ তারিখ মঞ্চস্থ হবে বাংলাদেশের শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাটক কী চাহ শঙ্খচিল। নাটকটির রচনায় মমতাজউদ্দিন আহমেদ। নির্দেশনায় খোরশেদুল আলম। থাকছে নকশার নাটক ভূমিসূতা দাসের নির্দেশনায় প্যান্ডেমিক।

২৩ ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হবে গয়েশপুর সংলাপের নাটক চৈতন্য। রচনা হর ভট্টাচার্য। নির্দেশনা সুদীপ্ত দত্ত। ২৪ তারিখ মঞ্চস্থ হবে মার্কিন মুলুকের নাটক। নিউ জার্সির ইসিটিএ-র নাটক আমি জগদীশ। সুদীপ্ত ভৌমিকের রচনায় নাটকটির নির্দেশনায় রয়েছেন সৌমেন্দু ভট্টাচার্য। ২৫ তারিখ অনুষ্ঠিত হবে নাটক একটি শব্দহীন সন্ধ্যা। পুনের নাটক থাকছে আলোর গান। নির্দেশনায় প্রতীক্ষা খাসনিস। শেষ দিনে থাকছে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় নাটক কোথাকার চরিত্র কোথায় রেখেছো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here