মিলন খামারিয়া, কল্যাণী: খনার বচনে আছে ‘নিত্তি নিত্তি ফল খাও,বদ্যি বাড়ি নাহি যাও’। বিজ্ঞানীরা বলছেন প্রতিদিন প্রত্যেক মানুষের ১৩০ গ্রাম করে ফল খাওয়া উচিত। ফল খাওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
সেই ফলের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই গতকাল ৭-ই জুন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হল ‘ফল বৈচিত্র্য মেলা-২০২৩’ (Fruit Diversity Fair -2023′). ‘ICAR-AICRP on Fruits বা ‘সর্বভারতীয় সমন্বিত ফল গবেষণা কেন্দ্র’ আয়োজিত বৈচিত্র্য মেলার এই আবেদন ফলচাষী এবং বাগানবিলাসীদের মধ্যে নজর কাড়ে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে চাষিরা এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন। সূদুর কোচবিহার থেকে তপন চক্রবর্তী সহ অন্যান্যরা এই মেলায় আম নিয়ে আসেন।
প্রশিক্ষণের অঙ্গ হিসাবে বিগত কয়েকবছর ধরেই নানান জাতের ফল গবেষণা-খামার-চত্বরে প্রদর্শিত হওয়ার পর কৃষকের তরফে দাবী ওঠে, যদি এমন কোনো বৈচিত্র্য মেলার বিশেষ আয়োজন করা যায়, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎপাদিত ফলের পাশাপাশি কৃষকও তাদের নিজেদের পণ্য পরিবেশন করতে পারবেন এবং সেই সঙ্গে কৃষক, ফল-বিলাসী ও বিজ্ঞান জগতের মানুষের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হবে।
তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সাল থেকে এই বৈচিত্র্য মেলার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত ঘটে। যদিও প্রকল্পের তরফ থেকে বিগত এক দশক থেকেই মন্ডৌরীতে অবস্থিত ফল গবেষণা খামারে শুরু হয়ে যায় ক্ষুদ্র পরিসরে ফল বৈচিত্র্য মেলার আয়োজন; যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষক, ছাত্র, গবেষক এবং তথ্য-দর্শনার্থীরা সমৃদ্ধ হতেন। বিসিকেভিতে উৎপাদিত নানান ফল ও তাদের বৈচিত্র্য সর্বদাই অনুষ্ঠানের সৌকর্য বৃদ্ধি করে এসেছে।
প্রায় ৪০ জন ফলচাষী ও বাগানবিলাসী এই মেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রায় ৬০ টি প্রকরণের আম প্রদর্শিত হয়েছিল এই মেলায়। এছাড়া কাঁঠাল, লিচু, লেবু, চেরি , করমচা, আতা, ব্ল্যাকবেরি, আতা প্রভৃতি ফল প্রদর্শন হয়েছিল। আটটি ক্যাটেগরিতে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ব্যাবস্থা করা হয়েছিল । ক্যাটেগরিগুলি হচ্ছে ১) দেশী/স্থানীয়/লৌকিক জাত, ২) ভারতের অর্থকরী আমের জাত, ৩) সঙ্কর জাতের আম, ৪) বিদেশী জাতের আম, ৫)বহু মরশুমী বা দোফলা/বারমাসী আম, ৬) আমের প্রক্রিয়াজাত পণ্য, ৭) আম ব্যাতিরেকে অন্য ফল, ৮) আম ব্যাতিরেকে অন্য ফলের সংরক্ষিত পণ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণার দ্বারা উৎপন্ন বিভিন্ন প্রকারের ফলও মেলাতে রাখা হয়েছিল; বিশেষ করে – আম, কলা, কাঁঠাল, পেয়ারা, সবেদা, ড্রাগন, ফলসা, চেরি, করমচা, জামরুল, কামরাঙা, প্রভৃতি ফল।
এই মেলায় আমের বৈচিত্র্য ছিল দেখার মতো। অনেক চাষী এমন উৎকৃষ্ট মানের ফল এনেছিলেন তা দেখে সবাই অবাক হয়ে যান। ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় মানুষ ও কৃষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এই মেলাকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। বেলা যত বাড়তে থাকে বহু লোকজনের সমাগম হতে থাকে।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে “বারোমাসে বারো ফল/না খেলে যায় রসাতল।” নীরোগ এবং সুস্থজীবন নিয়ে বসবাস করতে গেলে আমাদের পুষ্টিদায়ী ফল নিয়মিত গ্রহণ করতে হবে।
আর তা সারাবছর ধরেই গ্রহণ করা দরকার। কিন্তু সব ফল সারা বছর মেলে না। কিছু ফলের ফলন মরশুম নির্দিষ্ট কয়েকমাস মাত্র। তাই আম, জাম, কুল, ফলসা, আশফল ইত্যাদি ফল’কে প্রক্রিয়াকরণ করে যাতে সারাবছরই সুলভ করে তোলা যায়, সেই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে ভাবানোর জন্য উপস্থিত ছিল ‘বিশুদ্ধ এন্টারপ্রাইজ’। তারা চাটনি, আচার, আমসত্ত্ব, জ্যাম, জেলি, জুস, মোরব্বা, ফল’কে সংরক্ষণ করে দীর্ঘদিন মানুষের রসনা কীভাবে চরিতার্থ করা যায়, সেটা বোঝাতেই আজকের এই মেলায় উপস্থিত ছিল। তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত পণ্য খেয়ে সবাই প্রশংসা করেন। এই সংগঠন তাদের প্রাথমিক ট্রেনিং বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেন।
মেলায় উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক শ্রী শুভ্রজ্যোতি ঘোষ, গবেষণা অধিকর্তা অধ্যাপক গোরাচাঁদ হাজরা, স্নাতকোত্তর পঠনপাঠনের অধ্যক্ষ অধ্যাপক জীতেশ হোড়, অর্থ নিয়ামক শ্রী তমাল দেবনাথ প্রমুখ।
গবেষণা অধিকর্তা ড. হাজরা বলেন, “যারা এই মেলায় এসেছেন তারা দেখুন কত ধরনের আম চাষ হয় আমাদের রাজ্যে। আমের পাশাপাশি অন্যান্য ফলও আনা হয়েছে। ফল চাষের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। তারা ধান, গম, ফুল চাষের পাশাপাশি ফল চাষকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন।”
রেজিস্ট্রার শ্রী শুভ্রজ্যোতি ঘোষ বলেন, ” এই ফল মেলায় এসে আমি অভিভূত হয়েছি। আরও বেশি বেশি করে এjমন মেলা হলে ফল চাষের প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বাড়বে।”
অর্থ নিয়ামক শ্রী তমাল দেবনাথ বলেন, “আমি নিজে গ্রামের ছেলে। ছোটো বেলায় যে সব ফল দেখতাম ও খেতাম সেগুলো এখন দেখাই যায় না। এই ফল মেলাতে এসে সেগুলো দেখতে পেয়ে নিজের খুব ভাল লাগছে।”
ডিন (পি.জি) অধ্যাপক হোড় বলেন, “যে পরিমাণ আম বা অন্যান্য ফল-সব্জি উৎপাদিত হচ্ছে সেগুলোর যথাযথ প্রক্রিয়াকরণ করা প্রয়োজন। উৎপাদিত ফসলের যথাযথ প্রক্রিয়াকরণ করলে চাষীদের লাভ বেশি হবে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারও সেটাই চাইছেন।”
এই মেলা সম্পর্কে প্রকল্প আধিকারিক অধ্যাপক দিলীপ কুমার মিশ্র বলেন, “কৃষকদের জন্য যাবতীয় আয়োজন। তাদের চাহিদা অনুযায়ী ICAR-এর তত্ত্বাবধানে আমরা গবেষণা কাজ চালাই। এই মেলা কৃষকদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ বাড়িয়ে তোলে। কোন জাতটি কেন চাষ করবেন, সে বিষয়ে কৃষক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন এই মেলায় এসে। ছাত্র ও গবেষকেরাও ফল বৈচিত্র্য বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেন এই মেলায় এসে।”
মেলার জন্য আম চাষীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বিশিষ্ট উদ্যানবিদ অধ্যাপক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “যারা এই ফল গবেষণা কেন্দ্রে পূর্বে প্রশিক্ষণ নিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অথবা প্রেরণা নিয়ে ফলচাষ শুরু করেছেন তাদেরই বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিবিধ লৌকিক জাত আনার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, যা বাংলা থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।”
এদিন ‘গ্রাম সমৃদ্ধি ফাউন্ডেশন’-এর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন শ্রী ললিত আনন্দ আগরওয়াল। ২০১৪ সাল থেকে এই সংগঠন ফলগাছ লাগানোর কাজ করে চলেছে। এই সংগঠনের মাধ্যমে ললিতজী গ্রাম বাংলায় এখনো পর্যন্ত ছয় লক্ষ ফলের চারা বিবিধ কৃষকের জমিতে বাগিচা রচনার মাধ্যমে লাগিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য রাজ্যে এক কোটি ফলের গাছ লাগানো , কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা, তাদের জীবন জীবিকা উন্নত করা বলেও তিনি জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে উত্তরীয়, ফুল, মিষ্টি, শংসাপত্র,ব্যাগ ও পোশাক দিয়ে সম্মান জানানো হয়। গবেষণা অধিকর্তা অধ্যাপক হাজরা তাঁর হাতে সম্মান-সামগ্রী তুলে দেন।
মেলাটি ছিল যেন গতানুগতিক ছক ভাঙার এক মঞ্চ। তরুণ প্রজন্ম চিরাচরিত চাকরির গন্ডি ভেঙ্গে আবার ব্যবসা করতে চাইছে — এটা ছিল একটা বড় প্রাপ্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তৈরি আমের স্কোয়াশ প্রচুর বিক্রি হয়। ক্রেতারা সবাই প্রশংসা করেন।
ফল মেলায় উপস্থিত চাষিদের নিয়ে আসা ফলের বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কার ও শংসাপত্র দেওয়া হয়। বিভিন্ন বিভাগে চারাকুশলী শ্রী শঙ্কর দত্ত অনেক গুলো পুরষ্কার পান। এছাড়া বিপ্লব সরকার, সুশোভন বালা, গোবিন্দ সরকার, জয়দীপ সাহা সহ অনেকেই পুরস্কার পান। যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের সবাইকেই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।
মেলার আয়োজনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন অধ্যাপক মিশ্র, অধ্যাপক চক্রবর্তী’র পাশাপাশি অধ্যাপক ফটিক কুমার বাউরি, অধ্যাপক সঞ্জিত দেবনাথ, ড.দেবলীনা মাঝি ও ড.অনামিকা কর।