পিয়ালী মুখার্জী , দুর্গাপুর: বসন্ত পঞ্চমীর সকালে ঠাকুর ঘরে বাগদেবীর আরাধনার ফাঁকে আপন মনে তাঁকে বলতে শোনাগেল, কবিতার কাছে সেরিব্রাল পালসি হেরে গেছে ! মনের ইচ্ছে আর চেষ্টা তে কি না হয়। ওড়ার জন্য ডানার দরকার হয় না অদম্য জেদ আর নিজেকে প্রমাণ করার ইচ্ছার আর এক নাম দেবস্মিতা নাথ।
২০০১ এর ১৬ই এপ্রিল পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরের বিধাননগরে দেবস্মিতার জন্ম। যখন বয়স মাত্র ৬ মাস তখন তাঁর মা বাবা লক্ষ করেন ও আর পাঁচটা বাচ্চার মতো নয়। সে তখন ঠিকমত উঠে বসতে পারেনা। অনেক ডাক্তার দেখান কিন্তু কেউ কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেন না। ডাক্তারবাবুরা জানান দেবস্মিতা সেরিব্রাল পালসি রোগে আক্রান্ত। তাঁরা দিশাহীন হয়ে পড়েন, ভেলোর থেকে আসা এক নিউরো সার্জেন্টের কথায়, দেবস্মিতা কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হতে পারে তার জন্য ওকে ক্রমাগত সংস্কৃতির মধ্যে রাখতে হবে, গান নাচ কবিতা ইত্যাদি তাঁকে শোনাতে হবে। সাথে চলবে ফিজিও থেরাপী।
তিন বছর বয়সে যখন সে কথা বলতে শেখে তখন বহু স্কুলের প্রত্যাখ্যানের পর ওকে ভর্তি করা হয় এক অনামি সাধারণ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। সেখানেও বহু প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় সে। চলতে থাকে দেবস্মিতা আর তাঁর পরিবারের সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই।
পাঁচ বছর বয়স থেকেই দেবস্মিতার মধ্যে প্রকাশ পায় কবিতা প্রেম। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কে জয় করে কবিতার জন্য প্রথমবার পুরস্কার প্রাপ্তি। তার পর আর ওকে থেমে থাকতে হয়নি। প্রথাগত কবিতা শিক্ষার জন্য তাকে প্রথম প্রশিক্ষণ দেন শম্পা রায়চৌধুরী। যেখানেই কবিতার জন্য যায় দেবস্মিতা সেখান থেকেই পুরস্কার আসে তাঁর ঝুলিতে। এখন যে কোনো প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার ওর জন্যই তোলা থাকে, এতটাই দক্ষতা ও দখল তার কবিতার উপর।
তারই মধ্যে বঞ্চনা শুরু হয় স্কুল থেকে সব ক্ষেত্রে। চার বার পরিবর্তন করতে হয় স্কুল।
ঠিক ১৩ বছর বয়সে দুর্গাপুর এ ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এর কাছে ওয়ার্কশপ করার সুযোগ পায় ۔ তারপর নরেশ নন্দী-র ওয়ার্কশপ ۔ সেখান থেকে ব্রততী পরম্পরা, তারপর সরাসরি কাব্বায়ন এ ভর্তি হয় ৷ সেখানে দেড় বছর কবিতা আবৃতি শেখা এবং সেখানে অনেক গুণী জনের যেমন জগন্নাথ বসু , উর্মিমালা বসু-র কাছে অনেক কিছু শেখার সুযোগ আসে।
ওয়ার্কশপে একটা পুরস্কার ছিল যে দুর্গাপুর ব্রততী পরম্পরা তে সব থেকে বেশি নাম্বার পাবে সে বিনা অডিশনে বিনা পয়সায় কোলকাতা তে ওনার কাছে সরাসরি শেখার সুযোগ পাবে। নিজের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে সেই সুযোগ অর্জন করে দেবস্মিতা। ১৭ বছর বয়সে ওর সিডি তৈরী হয়ে যায় ۔ এই বয়সে দেবস্মিতা প্রথম অনুষ্ঠান করে সুজাতা সদনে তারপর রবীন্দ্র সদনে।
এই ভাবে ওর পথ চলা শুরু
মাত্র ১৮ বছরের শুরুতে ভাবনা রেকর্ডস থেকে “তোমায় প্রণমি” সিডি টি প্রকাশ হয় কোলকাতা প্রেস ক্লাবে। তার একটি পরম প্রাপ্তি হলো রাজভবনে প্রাক্তন মাননীয় রাজ্যপাল কেশরী নাথ ত্রিপাঠী র সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎকার ও দেবস্মিতার সিডি টি তাঁর হাতে তুলে দেওয়া। তারপর দুর্গাপুর থেকে প্রায় ই কোলকাতা আসা যাওয়া লেগেই থাকে অনুষ্ঠানের সূত্র ধরে৷ শুধু কোলকাতা নয়, তার আশে পাশে বিভিন্ন জায়গায় , যেমন শিয়ালদহ , চুঁচুড়া ,চন্দননগর এই সব জায়গা তে ۔ . কোলকাতা 91.9 Friends fm ۔ এ অনুষ্ঠান করেছে সে। এই ১৮ বছর বয়সে দেবস্মিতা দুটি সম্মান পায় সে৷ একটি হলো কনিষ্ঠতম বাচিক শিল্পী হিসাবে পঞ্চম বর্ষ বঙ্গ প্রমীলা কৃতী রত্ন সম্মান দ্বিতীয় টি হোল মনন সাহিত্য পত্রিকা থেকে কনিষ্ঠ তম বাচিক শিল্পীর সম্মান পায়।
তারপর কোলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে , আকাশ বাণী তে অনুষ্ঠানও কোলকাতার বিভিন্ন টিভি۔۔ চ্যানেল এ অনুষ্ঠান করা শুরু হয়।
এখন দেবস্মিতা একজন কলেজ ছাত্রী। ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশ এ অনার্স পড়ছে। তবে স্কুল জীবন একেবারে সুখকর ছিলোনা যে সকল স্কুলে পড়েছে সব গুলোতে এই এক অবস্থা ভর্তি হওয়ার পর সব ঠিক থাকে কিন্তু কবিতার ব্যাপার টা জানা জানি হলেই শুরু হতো নানা রকম মানসিক অত্যাচার। তাই সে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই উচ্চতর শিক্ষা গ্রহন করেছে।২০২১সাল দ্বিতীয় সিডি রিলিজ হয়েছে ২৩ ডিসেম্বর প্রেস ক্লাবে ৷সিডি র নাম শ্রদ্ধার্ঘ্য রবীন্দ্র নজরুল সংকলন।
নিজের পড়া শুনো ও কবিতা চর্চার পাশা পাশি দেবস্মিতা, আবাসিক এর দুস্থ বাচ্ছাদের পড়াতে ও কবিতা শেখাতে যায় প্রতি রবিবার ও সমাজের কাছে এই বার্তা দিতে চায় যে প্রতিবন্ধী হয়েও বাচিক জগতেও নিজের জায়গা করে নেওয়া যায়। ও চায় নিজের ইচ্ছে শক্তির জোরে ওর মতো যারা প্রতিবন্ধী আছে তারা ওকে দেখে অনুপ্রাণিত হোক।
দেবস্মিতার ঝুলিতে এখন অনেক সম্মান রয়েছে এটি একটি জাতীয় স্তরের পুরস্কার সারা ভারতে সব স্টেটে এটা দেওয়া হয়। পঞ্চম বর্ষ বঙ্গ প্রমীলা কৃতী রত্ন সম্মান কনিষ্ঠ তম বাচিক শিল্পী হিসাবে। নদীয়া জেলা ডিজিটাল মিডিয়া এসোসিয়েশন থেকে দেবস্মিতাকে সম্মানিত করা হয়। সিন্ধুরা একাডেমি থেকে জীবনানন্দ সভাঘরে কলকাতা সম্মানিত করা হয়।
বসন্ত পঞ্চমীর সকালে নিজের বাড়ির ঠাকুর ঘরে সরস্বতী পুজো দেওয়ার ফাঁকে আপন মনে তাঁকে বেশ কয়েকবার বলতে শোনাগেল, কবিতার কাছে সেরিব্রাল পালসি হেরে গেছে !
দেবস্মিতা ও তার বাবা মায়ের এই লড়াই রোগের বিরুদ্ধে ও সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে আরো স্বার্থক হোক। দেবস্মিতা জীবনে অনেক অনেক দূর এগিয়ে যাক। ইচ্ছে শক্তির জয় হোক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে।