বাগদা : লোকসভা ভোট শেষের অল্প দিনের মধ্যেই চার বিধানসভা কেন্দ্র বাগদা, রানাঘাট দক্ষিণ ,রায়গঞ্জ ও মানিকতলায় উপনির্বাচন। লোকসভা ভোটের নিরিখে মানিকতলা ছাড়া বাকি তিন কেন্দ্রেই এগিয়ে বিজেপি।
উপনির্বাচনেও এই গড় রক্ষাই লক্ষ্য তাদের। উল্টো দিকে, লোকসভায় রাজ্য জুড়ে যে সাফল্য এসেছে, সেই সূত্রেই পিছিয়ে থাকা বিধানসভাগুলিকে যথাসম্ভব অনুকূলে আনতে চাইছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। পাশাপাশি, বাম-কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য, ভোট-বাক্সে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা। এমন লক্ষ্যে তিন শিবিরই ভোট প্রচারের শেষ দিনে প্রচারের ঝড় তুলেছে । চড়ছে রাজনৈতিক তরজাও।
উপনির্বাচনের শেষ মুহূর্তের প্রচারে সোমবার বাগদায় গিয়েছিলেন অভিনেত্রী সায়ন্তিকা ব্যানার্জি।
আগামী বুধবার বাগদা বিধানসভার উপনির্বাচন I প্রচারের শেষ দিনে তৃণমূল প্রার্থী মধুপর্না ঠাকুরের সমর্থনে বাগদা গিয়েছিলেন অভিনেত্রী তথা বরানগরের বিদায়ক সায়ন্তিকা ব্যানার্জি I বাগদার বয়রা বাজার থেকে বাগদা পুরাতন বাজার পর্যন্ত রোড শো করেন তিনি। সায়ন্তিকা কে দেখার জন্য রাস্তার দু’ধারে অসংখ্য মানুষের ঢল নামে, রোড শো শেষ করে তিনি বাগদা পুরাতন বাজারে একটি পথসভায় যোগ দেন। দেখুন ভিডিও
উত্তর ২৪পরগনার বাগদা কেন্দ্রে প্রার্থী করা হয়েছে মমতাবালার কন্যা মধুপর্ণা ঠাকুরকে। সোমবার ছিল শেষ লগ্নের প্রচার । সেই প্রচারে এ দিন উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন তিনি। বললেন, “আমার দলের কেউ যদি কোনও অন্যায় করে থাকে আমি হাতজোড় করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন সঙ্গী হিসাবে ক্ষমা চাইছি। পার্থ ভৌমিক অন্যায় করলে তার শাস্তি দয়া করে অন্য কাউকে দেবেন না।”পাশপাশি, দলের কেউ কোনও অন্যায় করে থাকলে তাঁদের সবার হয়ে ক্ষমা চান তৃণমূল সাংসদ।
এদিন আষাঢ়ু গ্রাম পঞ্চায়েতের গাঙ্গুলিয়াতে প্রার্থী মধুপর্ণা ঠাকুরের সমর্থনে বুথ বৈঠক করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্দেশে পার্থ ভৌমিক বলেন,”আমি বাগদার মানুষের কাছে বলতে চাই ২০১৬ সালে আমাদের হারিয়েছেন,২০১৯ সালে হারিয়েছেন,২০২১ সালে হারিয়েছেন,২০২৪ সালে হারিয়েছেন।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “আমি যখন আসছিলাম কেউ একজন বলছিল দাদা রাস্তাটা করে দিন। আমি বললাম দায়িত্ব তো আপনারা আমায় দেননি রাস্তা করে দেওয়ার। দিয়েছেন বিজেপিকে। তাহলে দায়িত্ব দেবেন বিজেপিকে আর রাস্তা করে দিতে বলবেন আমায়? আমায় দিয়ে দেখুন করতে পারি কি না।”পার্থ বলেন, “মধুপর্না ঠাকুর বাগদার এবাড়ি ওবাড়ি দৌড়ে বেড়াবে। দয়া করে একবার কাজের সুযোগ দিন। আমি হাতজোড় করে বলছি। যদি ও কাজ করতে না পারে দুবছর পর আবার বিধানসভা নির্বাচন। তখন ফেলে দেবেন। কিন্তু একটা বার সুযোগ পাব না?”
এদিনের প্রকাশ্য সভা থেকে পার্থ বলেন, ‘লোকসভা ভোটে ২৯টি আসন দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনটে সিটে আমরা অল্পের জন্য হেরেছি। আমি বাগদার মানুষের কাছে আবেদন করছি , এ বার আমাদের প্রার্থীকে জয়ী করুন।’
দু’হাত জড়ো করে পার্থ বলে চলেন, ‘‘আমার দলের কেউ কোনও অন্যায় করে থাকলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক জন সৈনিক হিসাবে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। আর যদি আমি কোনও ভুল করে থাকি, তার শাস্তি আমায় দিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নয়।’’
প্রসঙ্গত, লোকসভা ভোটের নিরিখে ‘মতুয়া গড়’ বাগদায় ২০,৬১৪, রানাঘাট দক্ষিণে ৩৬,৯৩৬ হাজার ও রায়গঞ্জে ৪৬,৭৩৯ ভোটে বিজেপি এবং মানিকতলায় তৃণমূল ৩,৫৭৫ ভোটে এগিয়ে রয়েছে। যদিও মানিকতলায় ব্যবধান বাড়ানো ও বাকি তিন কেন্দ্রে ভোট-পরিসংখ্যান উল্টে দিতে ময়দানে নেমেছে তৃণমূল।
স্থানীয় স্তরে বা উপনির্বাচনে মমতা, অভিষেকদের সাধারণত দেখা যায় না। এই আবহে তৃণমূলের ভরসা স্থানীয় নেতারাই। যেমন, মানিকতলায় পরেশ পাল, অতীন ঘোষ, কুণাল ঘোষ-সহ চার জনের কমিটি তৈরি করে দিয়েছেন মমতা। পাশাপাশি, বাকি তিন কেন্দ্রেও দায়িত্বে তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব। বাগদায় বিশেষ দায়িত্বে রয়েছেন তৃণমূল সাংসদ পার্থ ভৌমিক।
পাশাপাশি, জোটের অঙ্ক মেনে মানিকতলা ও রানাঘাট দক্ষিণে সিপিএম, রায়গঞ্জে কংগ্রেস প্রার্থীরা লড়ছেন। কিন্তু বাগদায় জোটে জটিলতায় বামফ্রন্ট শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের পাশাপাশি প্রার্থী দিয়েছে কংগ্রেসও।
প্রচারে নেমে তৃণমূল ও বিজেপিকে কার্যত এক পঙ্ক্তিতে বসিয়ে সরব হতে দেখা যাচ্ছে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীদের। ডিওয়াইএফআই-এর মতো সিপিএমের গণ সংগঠনগুলিও প্রচারে নেমেছে।
সম্প্রতি ডিওয়াইএফআই-এর নেতৃত্বে শ্যামবাজার থেকে উল্টোডাঙা পর্যন্ত মিছিলও হয়েছে। বাগদায় ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থীর সমর্থনে প্রচারে ছিলেন সেলিম,সুজন।
রায়গঞ্জে দলের প্রার্থী মোহিত সেনগুপ্তের সমর্থনে প্রচারে গিয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরা। মানিকতলায় প্রার্থী রাজীব মজুমদারের সমর্থনে এ দিনই কেন্দ্রীয় মিছিলে দেখা গিয়েছে সিপিএমের সুজন, কলকাতা জেলা সম্পাদক কল্লোল মজুমদার, উত্তর কলকাতা জেলা কংগ্রেস সভাপতি রানা রায়চৌধুরী, প্রদেশ কংগ্রেসের সুমন রায়চৌধুরী, সিপিআইয়ের কলকাতা জেলা সম্পাদক প্রবীর দেব প্রমুখ।
বাগদা উপনির্বাচনে জিততে মরিয়া তৃণমূল নেতৃত্ব। তাই এই উপনির্বাচনের লড়াইয়ে ‘কৌশলগত’ বদল ও এনেছে বাংলার শাসকদল। প্রার্থীচয়ন থেকে শুরু করে প্রচার কৌশল , লোকসভা ভোটের তুলনায় সবকিছুতেই বদল এনে মতুয়াগড়ে ঘাসের ওপর জোড়াফুল ফোটাতে চাইছেন তৃণমূল নেতারা। লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় বিজেপির শোচনীয় ফল হলেও বনগাঁ লোকসভায় ফের জিতেছে বিজেপি। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর ওই আসনে ৭৫ হাজার ৮৫২ ভোটে তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাসকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন। তার মধ্যে বাগদা বিধানসভায় ২০ হাজার ৬১৪ ভোটে এগিয়েছিল বিজেপি। উপনির্বাচনে সেই ব্যবধান টপকে জয়ের জন্য লড়ছে তৃণমূল।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে বাগদা আসনে জিতে আসছে বিজেপি। ২০১৯ সালে প্রথম বার বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র জেতে বিজেপি। প্রথম বার প্রার্থী হয়েই জেঠিমা মমতাবালাকে পরাস্ত করেন শান্তনু। সেই ভোট থেকেই বিজেপির বাগদা-বিজয় চলছে। লোকসভা ভোটের পর বাগদার কংগ্রেস বিধায়ক দুলাল বর বিজেপিতে যোগদান করেন। ২০২১ সালে বাগদা আসনে দুলালকে টিকিট না দিয়ে বনগাঁ দক্ষিণের ‘দলবদলু’ বিধায়ক বিশ্বজিৎকে বাগদা আসনে প্রার্থী করে বিজেপি। বিধানসভায় বিজেপির ভরাডুবিতেও বাগদা ছিল পদ্মশিবিরে। ওই আসনে জিতেছিলেন বিশ্বজিৎই। কিন্তু জয়ের কয়েক মাস পরেই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগদান করেন বিজেপি বিধায়ক। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে শান্তনুর বিরুদ্ধে তাঁকেই প্রার্থী করে তৃণমূল। তাই বিজেপির বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। যে কারণে বাগদায় উপনির্বাচন হচ্ছে। সেই নির্বাচনে ২০ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধান ছাপিয়ে জিততে চাইছে শাসক তৃণমূল।