দেশের সময়: বাগদা বিধানসভা উপনির্বাচনে জিততে মতুয়াতেই ভরসা রাখলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই কেন্দ্রে জোড়াফুলের প্রার্থী করা হল তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরের মেয়ে মধুপর্ণা ঠাকুরকে। রাজনীতিতে একেবারেই নবাগতা বড় মা বীণাপাণি ঠাকুরের নাতনি মধুপর্ণা। কিন্তু ঠাকুরনগর ঠাকুরবাড়ির এই তরুণ সদস্যাকে সামনে রেখেই বাগদায় বাজিমাত করতে চায় তৃণমূল। লোকসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে বাগদায় পিছিয়ে তৃণমূল। ফলে বিধানসভা উপনির্বাচনে এই কেন্দ্রে জয়ের লক্ষ্য নিয়ে ঝাঁপাচ্ছে জোড়াফুল শিবির। দলের প্রার্থীর নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছে তৃণমূলে।
এদিকে এই কেন্দ্রে বামেরা প্রার্থী করেছে বাগদার প্রাক্তন ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক কমলক্ষ্মী বিশ্বাসের ছেলে গৌর বিশ্বাসকে। একসময় বাগদায় ফরওয়ার্ড ব্লকের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ২০০৬ সালে পালাবদল ঘটে। তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে এখান থেকে জয়ী হন দুলাল বর। পরে তিনি একাধিক দলবদল করেন।
২০১১ সালে শেষবার এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন তৃণমূলের উপেন বিশ্বাস। গত বিধানসভা নির্বাচনে বাগদা থেকে বিজেপির প্রতীকে জয় হন বিশ্বজিৎ দাস। পরে তিনি দলবদল করে যোগ দেন তৃণমূলে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিশ্বজিৎ বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন। ফলে বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয় তাঁকে। সেক্ষেত্রে খালি হয়ে যায় বিধানসভা আসনটি। সেখানেই মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে একজন তরুণীকে প্রার্থী করে চমক দিল তৃণমূল। তবে লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে বাগদা বিধানসভা আসনে বিজেপির চেয়ে কুড়ি হাজার ৬১৪ ভোটে পিছিয়ে রয়েছে তৃণমূল। ফলে বিধানসভা উপনির্বাচনে এখানে যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঠাকুরবাড়ির তরুণ মুখ মধুপর্ণা মতুয়া ভোট কতটা নিজের ঝুলিতে টানতে পারেন, এখন সেটাই দেখার। বিজেপি অবশ্য এখনও বাগদায় তাদের প্রার্থী ঘোষণা করতে পারেনি। বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি দেবদাস মণ্ডল জানিয়েছেন, রবিবার আমাদের প্রার্থী ঘোষণা হবে। তবে যিনিই প্রার্থী হোন না কেন, কর্মীরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মরিয়া হয়ে কাজ করবেন। সদ্য লোকসভা ভোট মিটেছে। বাগদা থেকে আমরা প্রচুর ভোটে এগিয়ে আছি।
বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ শান্তনু ঠাকুর আবারও কেন্দ্র মন্ত্রী হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আস্থা রেখেছেন তাঁর উপর। তাছাড়া মতুয়ারা বিজেপির সঙ্গেই আছেন। লোকসভাতেও তাঁরা আমাদের উজাড় করে ভোট দিয়েছেন। বিধানসভা উপনির্বাচনেও ভোটের ঝুলি ভরিয়ে দেবেন মতুয়ারা। তৃণমূলের যিনি প্রার্থী হয়েছেন তাঁকে বাগদার মানুষ কেউ চেনেন না।
তৃণমূল সূত্রের খবর, প্রাথমিকভাবে দল ঠিক করেছিল, বিশ্বজিৎকেই বাগদা বিধানসভা উপনির্বাচনে প্রার্থী করবে। কিন্তু বিশ্বজিৎ লড়তে না চাওয়ায় প্রাক্তন সাংসদ কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর ও দলের বর্তমান রাজ্যসভার সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরের মেয়ে মধুপর্ণাকে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নেয় তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। মেয়েকে প্রার্থী করায় তৃণমূল সুপ্রিমোকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন মমতাবালা। তিনি বলেন, বাগদার মানুষ চেয়েছিলেন মতুয়াদের মধ্যে থেকেই কেউ প্রার্থী হোক। দিদি সেই দাবি মেনেই মধুপর্ণাকে প্রার্থী করেছেন। আশা করি মতুয়ারা দিদিকে উজাড় করে ভোট দেবে।
এদিকে প্রার্থী হয়ে মধুপর্ণার বক্তব্য, রাজনীতিতে আমি একেবারেই নতুন। কিন্তু বাবা ও মাকে খুব কাছ থেকে রাজনীতি করতে দেখেছি। সুতরাং রাজনীতি আমার রক্তে। জুলজিতে স্নাতক ২৬ বছরের মধুপর্ণা বলেছেন, বাগদার মানুষের উদ্দেশে শুধু এটুকুই বলব, উন্নয়নই আমার একমাত্র লক্ষ্য। মতুয়া সমাজের উন্নয়ন করতে চাই। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে উন্নয়ন করছেন, তার সুফল যাতে বাগদার প্রতিটি কোণে পৌঁছয়, সেব্যাপারে নজর থাকবে আমার।
নির্বাচনী লড়াইয়ের ময়দানে নবাগতা হলেও রাজনীতিতে একেবারে আনকোরা নন মধুপর্ণা। তৃণমূলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে মায়ের সঙ্গে দেখা গিয়েছে তাঁকে। সম্প্রতি পৈত্রিক ভিটে থেকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করার অভিযোগ তুলে ধরনায় বসেছিলেন মধুপর্ণা। বড়মা বীণাপাণি দেবীর ঘরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, সংসদ মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ তুলে সরব হন তিনি।
আন্দোলনে নামেন। এ নিয়ে মতুয়াদের মধ্যে যথেষ্টই আলোড়ন ছড়ায়। বহু মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়ান। মতুয়া সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। সম্ভবত এটাকেই কাজে লাগাতে চাইছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। ওয়াকিবহাল মহলের অবশ্য বক্তব্য, এবারের লোকসভা নির্বাচনের যে ফল, তাতে দেখা গিয়েছে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে মতুয়া ভোটব্যাংক তৃণমূলের সঙ্গে নেই। তা পুরোটাই চলে গিয়েছে বিজেপির বাক্সে। ফলে এই ভোটব্যাংক যদি না ফেরানো যায়, তাহলে ২০২৬-এ মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁ লোকসভার অন্তত পাঁচটি বিধানসভা আবারও হারাতে হবে তৃণমূলকে। তাছাড়া বাগদায় বিজেপির টিকিটে জিতে বিশ্বজিৎ দাস দলবদল করায় এলাকার মানুষের মনে অসন্তোষ তৈরি হয়।
একইসঙ্গে বিশ্বজিৎ তৃণমূলের প্রতীকে এবার লোকসভায় প্রার্থী হওয়ায় দলের অন্দরেও ছিল চাপা ক্ষোভ। যার প্রভাব পড়েছে ভোটের ফলেও। মতুয়া সমাজের বাইরে থেকে প্রার্থী করা নিয়েও দানা বাঁধে অসন্তোষ। আর এরই জেরে বাগদা বিধানসভা উপনির্বাচনে দল চাইলেও প্রার্থী হতে রাজি হননি বিশ্বজিৎ।
মধুপর্ণা অবশ্য মতুয়াদের মন জয় নিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী। বলেন, আমি মতুয়াদের বাড়ি বাড়ি যাব। এটাই বোঝাব, বিজেপি ভুল বুঝিয়েছে। মতুয়াদের জন্য প্রকৃতই যদি কেউ উন্নয়ন করে থাকেন বা উন্নয়নের কথা ভাবেন, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আশা করি মতুয়ারা আমার কথা বুঝবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত শক্ত করতে বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূলকেই জেতাবেন। শনিবারই বাগদায় পৌঁছে গিয়েছেন মধুপর্ণা। শুরু করে দিয়েছেন জনসংযোগ। ভোট পর্যন্ত বাগদাতেই তিনি ঘাঁটি গেড়ে থাকবেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে, ঘনিষ্ঠ মহলে বাগদার প্রাক্তন বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস জানিয়েছেন, আপাতত সংগঠন জোরদার করার কাজেই সময় দিতে চান তিনি। কারণ, তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি হিসেবে গুরুদায়িত্ব রয়েছে তাঁর কাঁধে। সংগঠনকে চাঙ্গা করতে না পারলে ২০২৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে এখান থেকে জয় হাসিল করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে তৃণমূলের, সেটা ভালমতোই বুঝতে পারছেন বিশ্বজিৎ।
বিশেষ করে নিজের খাসতালুকে এবারের লোকসভা নির্বাচনে যেভাবে পিছিয়ে পড়েছেন বিশ্বজিৎ, তা নিয়ে দলের অন্তরেও জোর চর্চা চলছে। প্রশ্ন উঠছে, সংগঠনিক দুর্বলতা নাকি বিশ্বজিতের প্রতি বিমুখতা, কেন এভাবে পিছিয়ে পড়তে হল তৃণমূলকে। বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রতেই জীবনে প্রথম পঞ্চায়েত ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলেন বিশ্বজিৎ। তারপর থেকে ছিল শুধুই সাফল্য। পঞ্চায়েত সমিতির আসনে জয়ী হয়ে কর্মাধ্যক্ষ হন। ২০১১ এবং ২০১৬ সালে বনগাঁ উত্তর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়ে বিধায়ক হয়েছেন। বিশ্বজিতের বাড়ি গোপালনগরে। সেটিও এই কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। বিশ্বজিতের আত্মবিশ্বাস ছিল, এই কেন্দ্র থেকে এবার এগিয়ে থাকবেন। কিন্তু তা হয়নি। লোকসভা ভোটের ফল বলছে, নিজের খাসতালুকে অনেকটাই পিছিয়ে আছেন বিশ্বজিৎ। এই কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে বনগাঁ পুরসভা। পুরসভার ২২টি ওয়ার্ডেই বিশ্বজিৎ পিছিয়ে। ৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে চারটিতে পিছিয়ে। যার মধ্যে রয়েছে তাঁর নিজের পঞ্চায়েত গোপালনগর ১। গঙ্গানন্দপুর, গোপালনগর ২ এবং ঘাটবাওর পঞ্চায়েত থেকে শুধুমাত্র বিশ্বজিৎ এগিয়ে আছেন।
কেন এমন ফলাফল?
তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অনেকেই মনে করছেন, বিশ্বজিৎকে জেতাতে কিছু নেতা, জনপ্রতিনিধির মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল। গোষ্ঠীকোন্দলের চোরাস্রোত বয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া, বিশ্বজিৎ এই বিধানসভা এলাকায়, বিশেষ করে বনগাঁ শহরে প্রচারে কম সময় দিয়েছেন। এ সবের প্রভাব পড়েছে ভোটে।
বনগাঁ উত্তর অনেক দিন থেকেই তৃণমূলের গলার কাঁটা। ২০১৯ সালে তৃণমূল প্রার্থী বনগাঁ উত্তরে ২৮ হাজার ৩৭০ ভোটের ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী পরাজিত হয়েছিলেন ১০ হাজার ৪৮৮ ভোটের ব্যবধানে।
বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তথা তৃণমূল নেতা প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেন, ভোটে প্রার্থীকে জেতানোর বিষয়ে নেতাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা এবং আন্তরিকতার অভাব ছিল। জনপ্রতিনিধি এবং দলের একাংশের নেতাদের জনবিচ্ছিন্নতা এবং দাম্ভিকতাও আমাদের এখানে হারের কারণ।
বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি সৌমেন দত্তের কথায়, আমাদের নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। দায়িত্ব নিয়ে কেউ ভোট করাতে আসেননি। ফলে দ্রুত এই সব ঘাটতি পূরণ করতে না পারলে বিধানসভায় জেতা যথেষ্টই কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন তৃণমূল শিবিরের অনেকেই। আর তাই এখন বিধানসভা উপনির্বাচনের জিতে বিধায়ক হওয়ার চেয়ে সংগঠনের দিকেই বেশি করে মন দিতে চাইছেন বিশ্বজিৎ।