পিয়ালী মুখার্জী, বর্ধমান: কালনায় সাড়ম্বরে পালিত হলো এবারের মহিষমর্দিনী পুজো। চারদিনের এই পুজো শুক্র বার সপ্তমী থেকে শুরু হয়ে গতকাল রবিবার ছিল দশমী। মহিষমর্দিনী পুজো উপলক্ষে উৎসব মুখর ছিল মন্দির শহর কালনা।
মহিষমর্দিনী পুজোর জন্য সারা বছরের অপেক্ষায় থাকেন কালনা শহরের বাসিন্দারা। এই শহরে দুর্গা পুজোর থেকেও বেশি উন্মাদনা দেখা যায় এই মহিষমর্দিনী পুজোকে কেন্দ্র করে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই পাশের নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, হুগলি জেলা সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এই পুজো দেখতে আসেন। গত দু’বছর করোনার কারণে নিয়মরক্ষার পুজো হয়েছিল। এবার দর্শনার্থীদের ঢল নামবে বলে মনে করেছিল প্রশাসন। বাস্তবে চাপিয়ে গিয়েছে সে ধারণা।
বার্ষিক এই উৎসব ও পুজোর বাতাবরণ শান্তিপূর্ণ রাখতে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলে জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। কালনার মূল দুটি ঘাট ছাড়া অন্য সব ঘাটে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল। বেশ কিছু রাস্তা ওয়ান ওয়েও করা হয়েছিল।
আড়াইশো বছর ধরে শ্রাবণ মাসের নির্দিষ্ট তিথিতে কালনায় এই মহিষমর্দিনী পুজো হয়ে আসছে। কালনা তখন ছিল অন্যতম প্রধান নদী বন্দর। এখান থেকেই চাল-সহ অন্যান্য সামগ্রী নদীপথে রফতানি হত।
স্বপ্নাদেশ পেয়ে এক ব্যবসায়ী মা মহিষমর্দিনীর কাঠামো উদ্ধার করেন ভাগীরথী থেকে। সেই কাঠামো নিয়ে হোগলা পাতার ছাউনিতে পুজো শুরু করেন এলাকার ব্যবসায়ীরা। ব্যবসার একটি লভ্যাংশ তারা পুজোর জন্য রেখে দিতেন। সেই প্রথা আজও চলে আসছে। মা মহিষমর্দিনী দুর্গার এক রূপ।তাই এই পুজোর মধ্য দিয়ে শারদ উৎসবের সূচনা হয়ে গেল বলাই যায়।
করোনা এখনও বিদায় নেয়নি। তাই পুজো উপলক্ষে উদ্যোক্তাদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছিল প্রশাসন। তাই একসঙ্গে যাতে অনেক বেশি দর্শনার্থী ভিড় না করেন সেদিকে নজর রাখতে বলা হলেও গত পঞ্চাশ বছরের ভিড় কে চাপিয়ে গিয়েছে ২০২২ এর পুজো। এছাড়াও পুজো মন্দির চত্বরে পর্যাপ্ত মাস্ক ও স্যানিটাইজার রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনের তরফ থেকে।
প্রথমদিকে হোগলা পাতার ছাউনি দিয়ে মন্দির করে সেখানেই পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমবার পূজোর আয়োজন করতে করতে চৈত্র মাস এসে যাওয়ায়, ঠিক হয় যে শুক্লা সপ্তমী কিংবা পূর্ণিমাতেই মায়ের পূজো হবে। প্রথম ঠাকুর মশাই হিসেবে পূজো করেন হাট কালনা অঞ্চলের (পুরাতন হাট) ষোড়শী মুখোপাধ্যায়।
দেবী এখানে দশভুজা, সিংহপৃষ্ঠে দণ্ডায়মানা, আর পদতলে ত্রিশূলে বিদ্ধ মহিষাসুর। তাঁর দুই পাশে জয়া এবং বিজয়া চামর ব্যাজন রত। কিন্তু চৈত্র মাস ঝড় বাদলের মাস, এই সময় পূজায় নানান অসুবিধা পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া বছরের শেষ মাস হওয়াতে ব্যবসায়ীদেরও সারা বছর এর হিসাব নিকাশ করতে হয়। তাই মায়ের পূজো চৈত্রমাসের পরিবর্তে শ্রাবণমাসের শুক্ল সপ্তমী কিংবা পূর্ণিমাতে শুরু করা হয়।
পূজার সময় পরিবর্তন করতে সুদূর কাশী থেকে পণ্ডিতদের আনা হয়েছিল। বলাবাহুল্য, এই পূজায় কোনো বোধন কিংবা নবপত্রিকা নেই। ষষ্ঠীতে অধিবাস দিয়ে শুরু হয় পুজো, চলে দশমী অবধি। এছাড়া পুজো শুরুর কয়েক মাস আগেই প্রতিমা নির্মানের কাজও শুরু হয়। সেই সময় পুজোর নির্ঘন্ট জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বিলি করা হয়। বর্তমানে মায়ের সোনা-রুপোর বাসন এবং গয়না নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যাংকের লকারে রাখা হয়।
ষষ্ঠীর দিন সকালে ব্যাঙ্ক থেকে সমস্ত গয়না এনে মাকে সাজানো হয়। তাছাড়া এই অঞ্চলের পাশেই চকবাজারের সোনাপট্টি এলাকার পিতল কাঁসার মালিকরা মায়ের বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন বহুকাল আগে থেকই। সেই সময় নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যাবসায়ীরা দারোয়ান নিযুক্ত করেন যা আজও প্রতীকী হিসাবে বিশেষ এক পরিবারের হাতে আছে।
সেই প্রতীকী দরওয়ানের কোমরে কাপড়, মাথায় পাগড়ী, হাতে ঢাল আর তলোয়ার। সপ্তমী পুজোতে একটি ছাগ এবং অষ্টমীতে একটি ছাগবলি হয় এখনো। নবমীতে মানসিক পূজার পর সহস্র বলি হয় এই মন্দিরে। নবমীপুজোতে প্রথমে বন্ধনী পূজো করা হয় এবং প্রতিদিন দুঃস্থ এবং কাঙালীদের ভোজন-বস্ত্র দান করা হয়। প্রতিদিন রাতে যাত্রাপালা এবং পুতুল নাচের আসরও বসে। উল্লেখ্য পুতুল নাচ এই পুজোয় অপরিহার্য। কথিত আছে পুতুল নাচ ছাড়া মায়ের পুজো হয়না। এমনকি বর্ধমানরাজের আনুকুল্যে যেহেতু অম্বিকা নগরীর প্রতিষ্ঠা তাই প্রথম পূজো তাঁর নামেই হয়।
দ্বিতীয় পূজো পালচৌধুরি পরিবারের সম্মানার্থে করা হয়। তৃতীয় পূজো হয় প্রয়াত ভূপেনন্দ্র নাথ ব্যানার্জীর নামে, চতুর্থ পূজো হয় ভোলানাথ কুণ্ডর নামে এবং পঞ্চম পূজো হয় মতিলাল কুন্ডুর নামে। এই পূজো শেষ হবার পরই জনসাধারনের নামে পূজো হয়। এই পুজো উপলক্ষে এখানে বিরাট মেলাও বসে।
অতীতে মাকে ঘাড়ে করেই বিসর্জন করা হত, তবে বর্তমানে ট্রাকে করে নগর পরিক্রমার পর মায়ের ঘাটেই বিসর্জন করা হয়।মাকে বরন করা হয় হাবু সাহার বাড়িতে। এছাড়া নানা বাদ্য ও আলোকসজ্জা। সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় প্রতিমার বিশাল উচ্চতা। মায়ের আটচালার মন্দির চত্ত্বরে আছে ৪০ ফুট উচ্চতার নহবতখানা। যা ১৯২২ সালে তৈরী। এবারে তার একশো বছর। প্রতিবারের মতো এবারেও বসেছিল নহবতের আসর। পুজোয় বহু মানুষকে দন্ডী খাটতেও দেখা যায়। বিশাল মেলাতে মানুষের ঢল নামতে দেখা গিয়েছে। গতকাল ১৫ ই আগস্ট দশমীর দিন গভীর রাতে মায়ের বিসর্জন হয়।