সম্প্রতি গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় আচমকা সক্রিয় হয়ে উঠেছে দালাল চক্র। যাঁদের কোড নেম ‘ভারি।’ বাংলাদেশি মূল্যে মাত্র ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দিলেই যে কোনও লোককে(যাঁরা ‘ধুর’ নামে পরিচিত) চ্যাংদোলা করে কাটাতারের ও প্রান্তে পৌঁছে দেন ভারি–রা।
কী ভাবে চলছে এই কারবার? ধরা যাক, ও পারের কেউ সীমান্ত পার করতে চান। কিন্তু বৈধ পাসপোর্ট নেই। ইচ্ছুক ব্যক্তিকে জানানো হবে কাটাতারহীন এলাকা নয়, বরং তিনি অন্য প্রান্তে যাবেন কাটারুট দিয়ে। এই কাটারুটের অর্থ হলো, দু’দেশের মধ্যে থাকা কাটাতারের ফাঁক গলে তৈরি করা পথ। পদ্ধতিটা এ রকম, ধুরকে শীতের সকালে অথবা সন্ধ্যার দিকে নির্দিষ্ট জায়গায় আসতে হবে।
এক্ষেত্রে সাধারণত বিএসএফ জওয়ানদের টহলদারির ঠিক পরের সময়কে বেছে নেওয়া হয়। এরপর ওই কাটাতারের মাঝখানের ফাঁকা অংশে কাঠের পাটাতন তুলে ধরবেন দু’প্রান্তের অন্তত ছ’জন ভারি। সাত নম্বর ব্যক্তি ধুরকে মাটি থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে কাঠের পাটাতনের উপরে বসিয়ে বা শুইয়ে দিয়ে পিছন থেকে ধাক্কা দিলেই কেল্লাফতে! অনুপ্রবেশকারী পৌঁছে যাবেন অন্য প্রান্তে। আজব এই পদ্ধতি সীমান্ত এলাকায় পরিচিত ধাক্কা পাসপোর্ট নামে।
ভারত-বাংলাদেশের ২২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের মধ্যে ১৮৪৯ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত। জল সীমান্ত ১৭০ কিলোমিটার। দক্ষিণ এবং উত্তরবঙ্গ মিলিয়ে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার এলাকায় কোনও কাটাতার নেই। দিনের বিভিন্ন সময়ে এই ফেন্সিংহীন এলাকায় সবচেয়ে বেশি নজরদারি করেন বিএসএফের জওয়ানরা। যেখানে ফেন্সিং রয়েছে, সেখানে নজর তুলনামূলক ভাবে কম। তারই সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশিরা টাকার বিনিময়ে কাটাতারের মধ্যে দিয়ে রাস্তা তৈরি করে লোক পারাপারের কাজ করেন ।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বাংলাদেশ পুলিশের নজর এড়িয়ে সেখানকার নাগরিকদের সীমান্তের গন্তব্যে পৌঁছে দেন ও পারের দালাল বা ভারিরা। এর পর ওয়াকিটকির মাধ্যমে এ পারের দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁদেরই সহায়তায় ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ থেকে অরক্ষিত সীমান্ত এবং জঙ্গলঘেরা নদীপথ দিয়ে অবৈধ ভাবে বাংলায় প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার কাজ চলে টাকার বিনিময়ে।
দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে মূলত উত্তর ২৪ পরগনা , নদিয়া- মুর্শিদাবাদ দিয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টা বেশি করে থাকেন অনুপ্রবেশকারীরা। কারণ, ওখান থেকে কলকাতায় সহজে ঢুকে পড়া যায়।
অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গের হিলি,ফাঁসিদেওয়া,মহদিপুর, চ্যাংড়াবান্ধা দিয়ে এই বেআইনি কাজকর্মের প্রবণতা বেশি। কারণ, ওই সব এলাকার ভৌগোলিক সুবিধা নিয়ে সহজে চলে যাওয়া যায় শিলিগুড়িতে।
কি ভাবে ধাক্কা পাসপোর্ট – এর বিষয়টি গোয়েন্দারা জানতে পারেন !
ফোনের ও প্রান্ত থেকে একটা শব্দ শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন গোয়েন্দা কর্তারা। যে ফোনটা নজরদারিতে রেখেছিলেন তাঁরা, খবর পাওয়া গিয়েছিল ওই নম্বরের ব্যবহারকারী সম্ভবত কোনও জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির আবহে ওই সব শব্দ কোনও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কোডওয়ার্ড কি না, তা নিয়ে ধন্দও বেড়েছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের মনে।
সীমান্তে সন্দেহভাজন ব্যক্তির ফোনে ব্যবহার করা কোডওয়ার্ড ক্রসচেক করতে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, শব্দগুলি আসলে ‘ঘুসপেটিয়া’–দের(অনুপ্রবেশকারী) জন্য ব্যবহার করা সাঙ্কেতিক ভাষা। ফলে আর দেরি না করে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। বাড়াতে বলা হয়েছে নজরদারিও।
গোয়েন্দাদের কাছ থেকে সতর্কবার্তা পাওয়ার পরে অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়েছে বিভিন্ন সীমান্ত লাগোয়া জেলার পুলিশ এবং বিএসএফ। রাজ্যের আটটি জেলা থেকে প্রায় ৫৫ জন ভারিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে উত্তরবঙ্গের সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৯৪ জন অনুপ্রবেশকারীকে।
থার্মাল, নাইট ভিশন ক্যামেরা, সিসিটিভি ক্যামেরা এবং ড্রোনের মাধ্যমে বিশেষ নজরদারি চালানো হচ্ছে ফুলবাড়ির কাছে পঞ্চগড়, হিলির লাগোয়া দিনাজপুর এবং বিহারের কাছে ঠাকুরগাঁও এলাকায়। বিএসএফ সূত্রে দাবি করা হয়েছে, কাটাতার বসানো সীমান্ত তো বটেই, উত্তরবঙ্গের ১০ শতাংশ এলাকা কাটাতারহীন হওয়ায় জওয়ানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেখানেও সারপ্রাইজ় ভিজিট বাড়ানোর জন্য।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং এ পারে সে দেশের জঙ্গি গ্রেফতার হওয়ার পরে, বাহিনীকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন বিএসএফের (সীমান্ত রক্ষী বাহিনী) দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের আইজি মনিন্দর সিংহ পওয়ার। সাম্প্রতিক নির্দেশে জওয়ানদের বলা হয়েছে, তাঁদের সদাসতর্ক এবং সচেতন থাকতে হবে। তবে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া, ‘চরম’ পদক্ষেপ করা যাবে না। বিশেষ করে, উত্তর ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়া সীমান্ত নিয়ে বিএসএফ-কর্তার ওই বার্তা।