দেশের সময়, বনগাঁ : শুক্রবার সকালে একপ্রস্থ হামলা হয়েছে ইডির উপর। বসিরহাটের সন্দেশখালিতে। ইডির তিন জন অফিসার ভর্তি হাসপাতালে। তা নিয়ে চার দিকে ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছে। নক্ক্যারজনক এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন রাজ্যপাল বোস। তৃণমূলও বলেছে, হামলা কাঙ্খিত নয়। এসবের পরও এদিন রাতে আবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। দেখুন ভিডিও
বনগাঁ থেকে শঙ্কর আঢ্যকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসার সময় আবারও হামলা ইডির গাড়ির উপর। ভাঙল গাড়ির কাঁচ। হামলায় ইডির একটি গাড়ির পিছনের দিকের কাঁচ ভেঙে গিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছে, শুক্রবার গভীর রাত সাড়ে ১২ টা নাগাদ শঙ্কর আঢ্যকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন ইডির অফিসাররা বাড়ি থেকে বেরোন, সেই সময় ইডির গাড়ির সামনে একদল মহিলা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছিলেন। সেই সঙ্গে চলছিল ইডির অফিসার ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের উদ্দেশে কুকথার ছড়াছড়ি। একটি গাড়িকে লক্ষ্য কের থান ইটও ছুঁড়ে মারা হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে, বার বার গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করেন শঙ্কর আঢ্যর অনুগামীরা।
প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘনিষ্ঠ শঙ্করকে কিছুদিন আগেই নোটিস পাঠিয়ে ডেকেছিল ইডি। কিন্তু হাজিরা এড়িয়ে যান শঙ্কর। এক সময়ের দাপুটে নেতার বাড়ি ও আত্মীয় বাড়িতে তল্লাশির পর তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে সাড়ে ৮ লক্ষ টাকা উদ্ধার হয়েছে বলে জানান ইডির এক আধিকারিক। রাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে শঙ্করের বাড়িতে আসেন ইডি অফিসাররা। বেশি রাত পর্যন্ত তাঁরা সেখানেই ছিলেন।
পাশাপাশি বাঘাযতীনে তাঁর চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্টের বাড়িতে তল্লাশি চালায় ইডি। মেট্রোপলিটনে শঙ্কর আঢ্যর সহযোগী বাবলু দাসের ফ্ল্যাটেও তল্লাশি অভিযান চালায় ইডি।
সন্দেশখালির ঘটনার পর এ দিন কোনও ঝুঁকি নেয়নি পুলিশ। কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলেও বেলা বাড়তেই শঙ্করের বাড়ি এবং তাঁর শ্বশুরবাড়ির সামনে বনগাঁ থানার পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ একবার বাড়ির বাইরে এসেছিলেন শঙ্কর। সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি বিচারাধীন। তাই এই নিয়ে কিছু বলব না। ইডির আধিকারিকরা এসেছেন। তাঁরা নিজেদের মতো কাজ করছেন। তদন্তে সহযোগিতা করেছি।’
জ্যোতিপ্রিয়র হাত ধরেই একসময় রাজনীতির ময়দানে আসেন শঙ্কর। ২০০৫ সালে প্রথমবার বনগাঁ পুরসভার কাউন্সিলার হন। পরে চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন তিনি। বালুর ছত্রছায়াতেই উল্কার গতিতে বনগাঁ শহরে উত্থান ঘটে শঙ্করের। বনগাঁ জুড়ে শঙ্করের দাপট ছিল প্রশ্নাতীত। শঙ্করের একাধিক ব্যবসাও রয়েছে। কলকাতা, বনগাঁ ও পেট্রাপোল সীমান্তে তাঁর বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের অফিস রয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, একসময় ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ধুর সিন্ডিকেট চালাতেন শঙ্কর। বনগাঁ এবং বাগদায় তাঁর সোনার দোকান রয়েছে। বনগাঁ শহরে রয়েছে হোটেল। এর বাইরে বনগাঁয় শঙ্কর আঢ্যর বিপুল সম্পত্তিও রয়েছে। পাশাপাশি একাধিক খুনের ঘটনাতেও নাম জড়িয়েছিল দাপুটে নেতার। বনগাঁর বেতাজ বাদশা সেই শঙ্কর আঢ্যর বাড়িতে ইডির হানাদারিতে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে।
ইডির দাবি, নথিপত্র ঘেঁটে লেনদেন সংক্রান্ত যে সকল তথ্য পাওয়া গিয়েছে তা সন্দেহজনক।
শঙ্করের স্ত্রী জ্যোৎস্না আঢ্য তাঁর স্বামীর গ্রেফতারি প্রসঙ্গে বলেন, “সকাল সাড়ে সাতটা থেকে তল্লাশি চলছে। ব্যবসার কাগজপত্রই দেখেছেন ওঁরা সারা দিন ধরে। আমরা সবরকম সহযোগিতা করেছি। হঠাৎ রাত ১২টা নাগাদ এক অফিসার এলেন। একটা কাগজ দেখিয়ে বললেন, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের চিঠি এটা। তার ভিত্তিতেই ওঁকে (শঙ্কর) গ্রেফতার করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হল ওঁকে।জ্যোৎস্না বলেন, ‘‘জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দলের জেলা সভাপতি ছিলেন। সেই সূত্রে তিনিও আসতেন। আমরাও যেতাম। তার জন্য গ্রেফতার করতে হবে!’’ দেখুন ভিডিও
শেষ অবধি পাওয়া খবরে, কলকাতার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শঙ্কর আঢ্যকে। বনগাঁ পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও তৃণমূল নেতার একাধিক ঠিকানায় এদিন তল্লাশি চালায় ইডি।কেন্দ্রীয় এজেন্সি সূত্রে খবর, শঙ্কর আঢ্যর শ্বশুরবাড়ি থেকে উদ্ধার সাড়ে ৮ লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। ইডি সূত্রে খবর, বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি। দেখুন ভিডিও
রেশন দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পরেই প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এই তৃণমূল নেতার একাধিক বিদেশি মুদ্রা বিনিময় সংস্থাগুলিতে নজর পড়ে ইডির আধিকারিকদের। রেশন দুর্নীতির টাকা ঘুরপথে শঙ্করের বিদেশি মুদ্রা বিনিময় সংস্থার মাধ্যমে পাচার হত কি না, রেশন দুর্নীতির সঙ্গে তাঁর যোগ রয়েছে কি না, বিদেশি বিনিময় সংস্থার আড়ালে কোনও আর্থিক লেনদেন ঘটেছে কি না তা খতিয়ে দেখতেই এ দিনের ইডির অভিযান বলে জানা গেছে।
বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যানের পাশাপাশি তৃণমূলের একাধিক সংগঠনেরও মাথায় ছিলেন শঙ্কর। তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না আঢ্যও বনগাঁ পুরসভার চেয়ারপার্সন ছিলেন। তিনি বর্তমানে পুরসভার ভাইস চেয়ারপার্সন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বনগাঁ থেকেই প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন শঙ্কর। কিন্তু দল তাঁকে প্রার্থী না করায় ভোটের প্রচার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন শঙ্কর। রাজ্যজুড়ে প্রবল তৃণমূল হাওয়াতেও গোষ্ঠীকোন্দলে দীর্ণ বনগাঁয় সবক’টি আসনে হারতে হয় দলকে। এর পরেই দলের ভিতরে ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়েন শঙ্কর। দলের সব পদ থেকেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
বনগাঁর শিমুলতলায় শঙ্করের বাড়ির ১০০ মিটারের দূরেই তাঁর শ্বশুর বিনয় ঘোষের বাড়ি। এ দিন সকাল সাতটা নাগাদ ইডি আধিকারিকরা একযোগে দুই বাড়িতেই অভিযান চালান। শঙ্কর সে সময় বাড়িতে ছিলেন না। তিনি সকাল দশটা নাগাদ বাড়িতে এলে তাঁকেও জেরা করেন ইডির অফিসাররা। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় শঙ্করের পরিবার এবং তাঁর শ্বশুরবাড়ির সদস্যদেরও। ঘরের আলমারি খুলে বেশ কিছু নথিপত্রের খোঁজেও তল্লাশি চলে। শঙ্করের স্ত্রী, ছেলে এবং ভাই মলয় আঢ্যকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেন ইডি অফিসাররা। প্রায় এক ঘণ্টা পর ইডির আধিকারিকরা শঙ্করের শ্বশুর এবং শালার স্ত্রীকে নিয়ে শালার শ্বশুরবাড়িতেও গিয়েছিলেন।
শঙ্করের ভাই মলয়ের আইসক্রিমের কারখানা রয়েছে গাইঘাটার কালোপুর দোগাছিয়ায়। দুপুরে মলয়কে নিয়ে সেই কারখানাতেও তল্লাশি চালিয়েছে ইডি। শঙ্করের বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের বনগাঁর অফিস চালান অঞ্জন মালাকার। অঞ্জনের বাড়িও শিমুলতলায়। অন্যদিকে, কলকাতার অফিসের দায়িত্বে রয়েছেন বিশ্বজিৎ ঘোষ ওরফে বাপ্পা। ইডি ওই দুই কর্মচারীর বাড়িতেও অভিযান চালায়। শঙ্কর ওরফে ডাকুর বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাগুলিতে তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও একাধিক আত্মীয় ডিরেক্টর পদে রয়েছেন। আর্থিক দুর্নীতিতে শঙ্করের সঙ্গে তাঁর আত্মীয় এবং দুই কর্মচারীর কী যোগ রয়েছে, তা খতিয়ে দেখতেই এ দিনের অভিযান বলেই জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, ঠিক কতদূর ছড়িয়ে রয়েছে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ‘দুর্নীতি’র জাল? মন্ত্রী নিজেই কি নেমেছিলেন ধান ব্যবসায়? খোদ মন্ত্রী চেম্বারেই ‘খাজানা’র খোঁজ পেল ইডি? ইডি সূত্রে সামনে এল অবাক করে দেওয়ার মতো তথ্য। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর, খাদ্য দফতর থেকে সরে যাওয়ার পরে, বন দফতরে বসেই খাদ্য দফতরে দুর্নীতি-চক্র চালিয়েছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। বাকিবুর বা অন্য কারও মাধ্যমে নয়, নিজেই নাকি ধান ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সল্টলেকের দফতরে হানা দেওয়ার পর, এমনটাই মনে করছে ইডি।
রেশন দুর্নীতি মামলায় মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক (Jyotipriya Mallick) এখন জেলে, ইতিমধ্যেই তাঁর দফতরে হানা দিয়েছে ইডি (ED)। রেশন বণ্টন দুর্নীতি (Ration Scam) মামলায় এই প্রথম কোনও মন্ত্রীর দফতরে যায় কেন্দ্রীয় এজেন্সি (Central Agency)। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের (Central Force) নিয়ে সল্টলেকের অরণ্য ভবনে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের অফিসে গিয়েছিলেন ইডি আধিকারিকরা (ED Officer)। খাদ্য দফতরের পর বন দফতরের মন্ত্রী হয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। বন দফতরের অফিসে (Forest Department Office) খাদ্য দফতরের কোনও নথি পাওয়া যায় কি না, তার খোঁজেই গতবছরের শেষে হানা দিয়েছিল ইডি (ED)। শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ বনগাঁর শিমুলতলায় শঙ্করের শ্বশুরবাড়িতে হানা দেয় ইডি।
প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে তল্লাশি অভিযান চলে। পরে তাঁর বাড়িতেও যান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সাত জন আধিকারিক। এর পর ফের তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যায় ইডির একটি দল। সেখানে রাত সাড়ে ন’টা পর্যন্ত তল্লাশি চালান তারা। ইডি সূত্রে দাবি, শঙ্করের শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে আট লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এর পরেই ফের শঙ্করের বাড়িতে আসনে ইডির গোয়েন্দারা সেখান থেকেই রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ গ্রেফতার করা হয় তাঁকে।
উল্লেখ্য, এদিন সকালেই সন্দেশখালিতে রেশন দুর্নীতি মামলার তদন্তে শেখ শাহজাহানের বাড়িতে গিয়েছিলেন ইডির তদন্তকারী অফিসাররা। সঙ্গে ছিলেন সিআরপিএফ জওয়ানরাও। সে সবের মধ্যেই প্রায় ৮০০-১০০০ জনের উত্তেজিত জনতা ঘিরে ফেলেছিল ইডির অফিসার ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের। তীব্র রোষানলের মধ্যে পড়তে হয়েছিল ইডিকে। ভাঙচুর হয়েছিল গাড়ি। আক্রান্ত হয়েছেন ইডির তিন অফিসার। তাঁরা এখন হাসপাতালে ভর্তি। এসবের মধ্যেই মধ্যরাতে ফের ইডির গাড়ি লক্ষ্য করে হামলার অভিযোগ।