Birds: বাংলার লৌকিক ছড়ায় পাখি বৈচিত্র্য

0
784

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

আঞ্চলিক নামে পাখির বৈচিত্র্য নিয়ে তখন কাজ করছি। ইতোমধ্যে জলপাইগুড়ি জেলায় গিয়েছি লিচুর পুরনো বাগান সার্ভে করতে। সঙ্গে লোকসংস্কৃতির একজন গবেষক ছিলেন। আমাদের হাতে এলো জেলার একটি লৌকিক ছড়া। লোকসংস্কৃতিবিদ ড. নির্মলেন্দু ভৌমিক তাঁর গ্রন্থে ছড়াটি সংকলনও করেছেন। বেশ মজার ছড়া সেটি। তাতে নানান পাখির কথা রয়েছে। পড়লে এক লহমায় স্থানীয় অঞ্চলের ইকোসিস্টেমটিও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আগে ছড়াটি পড়ে নেওয়া যাক

অ্যাং সারো প্যাং সারো দেখি,
অারো দেখি পোড়া সারো ,
তার পাছত্ দেখিয়া নিলে গিরস্তের পারো ।।
বোগদুল , ভ্যাটরেঙা দেখিল তলপাখে মুখ।
মাচের লোভত্ মাদরেঙা জলত্ মারে ডুব।।
মাছো চিনে মাদরেঙা, পঙ্খী চিনে ডাল।
মাছের লোভত্ কানী বগুলা ধরিছে ধিয়ান।।
চিক্কণ বাগেড়া দেখিল্ লেখা-জোখা নাই।
চিত্র করি খঞ্জনী পাখি আইচ্চে ঠাঁই ঠাঁই।।
এক পাখে নেখা আছে কালু বিন্দাবন।
এক পাখে নেখা আছে দশমুন্ড রাবণ।।
ঝেঁচু বেটা পড়া-মুহা পরার খায় অগলা।
শুকান ডালে বসিয়া কান্দে বাজ আর বগুলা ।।
পাখীর মইধ্যে পোড়া সারো তিরির মইধ্যে ত্যালকালো।
পুরুষো মইধ্যে আসিকো ভমরা।।

ছড়ার মধ্যে ইকোসিস্টেমে পাখি-বৈচিত্র্যের একটি মনোরম চিত্র ফুটে উঠেছে। জানা যায় এইরকম পাখির ছবি বিছানার চাদরে বা কোনো বস্ত্রখণ্ডে সূঁচসুতো দিয়ে সেলাই করে আঁকা হয় এবং সুর করে তা আবৃত্তি করে শোনানো হয়। এটা একটি নারী-সংস্কৃতি। শেকড় সংস্কৃতির মধ্যেই গ্রামীণ শিশুকে তার মা পাখি চেনাতে শেখান। এবার পাখিগুলির পরিচয় নেওয়া যাক

১. ‘সারো’ মানে হচ্ছে শালিখ পাখি। বাংলায় নানান প্রজাতির শালিখ রয়েছে। যেমন — ঝুট শালিখ বা Jungle Myna; গো-শালিখ বা Indian Pied Myna; কাঠ শালিখ বা Grey Headed Myna; এছাড়াও সচরাচর দৃশ্য ভাত-শালিখ বা Common Myna. এর সঙ্গে মনে রাখতে হবে পাহাড়ি ময়নাও শালিখ গোত্রীয়৷ এইসব মিলিয়েই যাবতীয় ‘সারো’ বা শালিখ সম্প্রদায়।
২. শালিখ দেখার পর (তার পাছত্) গৃহস্থের পায়রা (গিরস্তের পারো) Pigeon দেখে নিতে হবে৷
৩. ‘বোগদুল’ আর ‘ভ্যাটরেঙ্গা’ হচ্ছে যথাক্রমে বাদুড় (Bat) ও চামচিকে। এদের ডানা থাকলেও এরা কিন্তু পাখি নয়, স্তন্যপায়ী প্রাণী। এরা ‘তলপাখে মুখ’ করে থাকে, অর্থাৎ পা উপরে আটকিয়ে নিচে মাথাটি ঝুলিয়ে বিশ্রাম নেয়।
৪. ‘মাদরেঙ্গা’ বা মাছরাঙ্গা পাখি মাছ শিকারের জন্য পাশ থেকে উড়ে এসে জলে ডুব দেয় (মাচের লোভত্ মাদরেঙ্গা জলত্ মারে ডুব)। এ রাজ্যে মাছরাঙ্গার নানান বৈচিত্র্য। যেমন ছোটো মাছরাঙ্গা বা Common Blue Kingfisher (Aleedo atthis), পাকড়া মাছরাঙ্গা বা Pied Kingfisher ( Ceryle rudis ), সাদাবুক মাছরাঙ্গা বা White Breasted Kingfisher ( Halcyon smyrnensis ), সবুজ মাছরাঙ্গা বা Green White Kingfisher ( Pelargopsis capensis ) , লাল মাছরাঙ্গা বা Ruddy Kingfisher ( Smyrensis spp )।
৫. মাছ শিকারের জন্য ‘কানী বগুলা’ বা Pond Heron (কোঁচবক) ওৎ পেতে বসে রয়েছে, যেন ধ্যানমগ্ন (মাছের লোভত্ কানী বগুলা ধরিছে ধিয়ান)।
৬. ‘চিক্কণ বাগেড়া’ হচ্ছে ছোটোবক বা Little Egret, হতে পারে এই গোষ্ঠীর মধ্যে গো-বক বা Cattle Egret কেও ধরা হচ্ছে।
৭. খঞ্জনী পাখি বা Wagtail, পশ্চিমবঙ্গে তাদের নানান বৈচিত্র্য — বড় পাকড়া খঞ্জন বা Large Pied Wagtail ( Motacilla maderas patensis ), সাদা খঞ্জন বা White Wagtail ( Motacilla alba ), পাকড়া খঞ্জন বা Pied Wagtail ( Motacilla yarrelli ), ধূসর খঞ্জন বা Gray Wagtail ( Motacilla cinerea ), হলুদ খঞ্জন বা Yellow Wagtail ( Motacilla flava ), হলদে মাথা খঞ্জন বা Yellow Headed Wagtail এবং বন খঞ্জন বা Forest Wagtail ( Motacilla indica ).
৮. এখানে ঝেঁচু বা ফিঙ্গে (Black Drongo — Dicrurus adsimilis ) পাখির কথা পাই — ঝেঁচু বেটা পড়া-মুহা পরার খায় অগলা। অর্থাৎ ফিঙ্গেপাখি যেন পোড়ামুখো, তারা অন্য পাখির শিকার ছিনিয়ে নিয়ে খায়।
৯. ছড়ায় উল্লেখ আছে বৃহৎ বৃক্ষের শুকনো ডালে বসে চিৎকার করছে বাজ ( Accipiter nisus ) আর বগুলা (Heron গ্রুপের বক)। কানি-বগুলা বা Pond Heron ছাড়া এ রাজ্যে হেরন গ্রুপের আর অন্যান্য প্রজাতির বক রয়েছে — ধূসর বক বা Grey Heron — Ardea cinerea, Purple Heron — Ardea purpurea , নিশিবক বা Night Heron — Nycticorax nycticorax ইত্যাদি।

পাখি বৈচিত্র্য বর্ণনা করে শেষে কালোর নানন্দিকতা বিচার করা হয়েছে। লৌকিক সমাজের বিচারে পাখির মধ্যে ‘পোড়া সারো’ বা কালো ময়নাই সেরা যে শিস দিতে পারে, গাইতে পারে, কথা বলতে পারে। স্ত্রী-র মধ্যে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা তন্বীনারীর কদর বেশি, যার ত্বক চকচকে ( এখানে ‘ত্যালকালো’ বলে উল্লেখিত) আর পুরুষের মধ্যে রসিক ভ্রমর (‘আসিকো ভমরা’ বলে অভিহিত, যে কালো ভ্রমর ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়) সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লোকসংস্কৃতির সংগ্রহে শ্লীল-অশ্লীল বিচার করা হয় না। তার টেক্সট যেমন ভাবে থাকে, তেমনই রাখতে হয়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ছড়া সংগ্রহ করতে গিয়ে ‘ভাতারখাকি’-র জায়গায় ‘স্বামীখাকি’ বলে এডিট করেছিলেন, তারজন্য আজও সমালোচিত হন।

Previous articleAjay Devgn : ‘একশো শয়তান’কে একা সামলাবে তব্বু! অজয় দেবগনের ভোলার দ্বিতীয় টিজার আসছে ২৪ জানুয়ারি
Next articleWeather Update: বাংলা থেকে বিদায় নিচ্ছে শীত? কি জানাচ্ছে হাওয়া অফিস

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here