দেশের সময়: তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বরাবর ভারতের স্বার্থ দেখেন। আর প্রতিবেশী দেশের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে জলাঞ্জলি দেন নিজের দেশের স্বার্থ। আগামী বছর ভোট বাংলাদেশে। ফলে এই অভিযোগে বিরোধীরা এখন তাঁকে আরও বেশি করে চেপে ধরবেন, সেটা জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ফলে জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে দিল্লিতে পা রেখেই তিনি সরব হলেন তিস্তার জল বণ্টন নিয়ে। দিল্লি সফরে এসে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে নিজেদের দেশের স্বার্থ নিয়ে কথা বলবেন, আগেই তার আভাস দিয়েছিলেন সেদেশের বিদেশ সচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিস্তার জলবণ্টনের বিষয়টি যেমন উত্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তেমনই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। সেগুলির জলবণ্টন নিয়েও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলবেন তিনি।
বাংলাদেশের তরফে আরও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বকেয়া তিস্তা চুক্তি ছাড়াও গঙ্গা-পদ্মার জলবণ্টন চুক্তি পুনর্নবীকরণ নিয়েও ভারতের সঙ্গে কথা বলবেন তাদের প্রধানমন্ত্রী। দু’দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে ত্রিশ বছরের জন্য যে চুক্তি হয়েছিল, তা শেষ হচ্ছে ২০২৬ সালে। এই তিন দশকের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চুক্তিতে অদলবদল চায় দু’দেশই। দিল্লিও মনে করে, এখন থেকে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে গেলে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্রই তা পুনর্নবীকরণ করা সম্ভব হবে। নতুবা অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের বিদেশ সচিব মোমেন আগেই জানিয়েছেন, ২০১১ সালে নীতিগত সমঝোতার পরও বকেয়া রয়ে গিয়েছে তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি। গত কয়েক বছর ধরে শেখ হাসিনা যখনই ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন, বিষয়টি উত্থাপন করেছেন তিনি। ভারতের তরফে আশ্বাসও মিলেছে। কিন্তু ওটুকুই। আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এক বছর আগে দিল্লি সফরে এসেছিলেন হাসিনা। তখনও তিনি তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে কথা বলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। মোদি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, দেশে রাজনৈতিক সহমত গড়ে দ্রুত রূপায়ণ করা হবে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি।
শুক্রবার দিল্লিতে পা রেখেই মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন হাসিনা। দেখা হওয়া মাত্রই তিনি জানতে চান, তিস্তা চুক্তি কী হল। কারণ, আর দেরি করতে পারছেন না তিনি। তাঁর দেশে ভোটের মোটেই আর দেরি নেই। ভোটের আগে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনও ফয়সলা না হলে বিরোধীরা মোটেই তাঁকে ছেড়ে কথা বলবে না। এতে রাজনৈতিকভাবে চাপে পড়তে হবে তাঁকে। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়িত করাতে হাসিনা যেমন তৎপর, কারণ তাঁর দেশে ভোট। একইভাবে মোদিও বিষয়টি নিয়ে তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না, কারণ, ভারতেও লোকসভা ভোট দোরগোড়ায়। ফলে দু’পক্ষই বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো চাপে।
আর সবচেয়ে বড় কথা, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই তিস্তা চুক্তি নিয়ে প্রথম থেকেই জোরালো প্রতিবাদ করে আসছেন। তাঁর সাফ কথা, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে উত্তরবঙ্গের বহু জনপদে চাষ বন্ধ হয়ে যাবে। সেখানে সেচের জল মিলবে না। তাঁর প্রস্তাব, বিকল্প নদী-জলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু কোনওভাবেই তিস্তা নয়। রাজনৈতিক এই চাপানউতোরের মধ্যে শেষ পর্যন্ত তিস্তার জল কোন দিকে গড়ায় সেটাই দেখার।
গত বছর নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে মোদি-হাসিনা বৈঠকের পর কুশিয়ারা নদীর জলবণ্টন সহ মোট সাতটি মউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু সেই তালিকায় ছিল না তিস্তা। সেসময় সাংবাদিক সম্মেলনে হাসিনা বলেছিলেন, দ্বিপাক্ষিক কিছু বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। আশা করব, আগামী দিনে বকেয়া বিষয়গুলির দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, এখনও পর্যন্ত তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে কোনও সুরাহা না হলেও কুশিয়ারা নদীর জলবণ্টন চুক্তি ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
কারণ, ১৯৯৬ সালে গঙ্গা-পদ্মা জলবণ্টন চুক্তির আড়াই দশক পর ফের কোনও নদীর জলের ভাগাভাগি নিয়ে সমঝোতা করেছে নয়াদিল্লি ও ঢাকা। ১৯৯৬ সালে ত্রিশ বছরের জন্য যখন গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি হয়েছিল, তখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। ফলে তাঁর জমানাতেই তিস্তার জলবণ্টন চুক্তিও সম্পন্ন করতে চেষ্টার কোনও কসুর করছেন না বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
বিদেশ মন্ত্রকের একটি সূত্রের খবর, তিন বছর আগে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর নজরদারিতে তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী চুক্তির খসড়া তৈরি হয়। তাতে বিশেষভাবে নজর রাখা হয় বাংলার স্বার্থের কথা। উত্তরবঙ্গের কৃষকরা যাতে সেচের জল পান, সেজন্য পৃথক একটি জলাধার তৈরিরও পরিকল্পনা রাখা হয়েছে খসড়ায়। যদিও বাংলার স্বার্থ বিঘ্নিত করে বাংলাদেশকে মোটেই তিস্তার জল দিতে নারাজ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০১১ সালে তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে অন্তর্বর্তী চুক্তিতে সায় দিয়েছিল ভারতের মনমোহন সিংয়ের সরকার। কিন্তু প্রবল আপত্তি তুলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে শুখা মরশুমে উত্তরবঙ্গে প্রবল জলাভাব দেখা দেবে।
শুক্রবার ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু এজেন্ডায় না থাকলেও মোদির সঙ্গে তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে কথা বলেছেন হাসিনা। সূত্রের খবর, হাসিনাকে মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিস্তার জলবণ্টনে ভারত প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
সামগ্রিক সহমতের ভিত্তিতে যাতে এই চুক্তি হতে পারে, সেই রাস্তা খুঁজছে ভারত। কিন্তু মোদির বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে নতুন করে বলার মতো কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। ফলে জি-২০ সম্মেলনের মঞ্চে যোগ দিলেও তিস্তার জলবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে শূন্য হাতেই এবারও ফিরতে হবে হাসিনাকে।
এরপর নিজের দেশের মাটিতে বিষয়টি নিয়ে তিনি কতটা বিরোধী দলের চাপের মুখে পড়বেন, সেটা সময়ই বলবে। তবে শুক্রবার ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেগুলি হল ভারতীয় ও বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময়ের পথ মসৃণ করা, কৃষি সংক্রান্ত বিষয় এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ানো।
পাশাপশি বিদ্যুৎ ও রেলপথের কয়েকটি প্রকল্প উদ্বোধন হয়েছে। ভারতের এনপিসিআই এবং বাংলাদেশের ব্যাঙ্কের মধ্যে নেটওয়ার্ক টু নেটওয়ার্ক একটি চুক্তিতে স্বাক্ষরিত হয়েছে। যা উভয় দেশের আর্থিক লেনদেনের পথে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে চলেছে বলে মত ওয়াকিবহাল মহলের।
মোদির বাসভবনে টানা দেড় ঘণ্টা বৈঠক করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সূত্রের খবর, ওই বৈঠকে হাসিনা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যতই তাঁরা চীনের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিন না কেন, বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু ভারতই। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একেবারেই বাণিজ্যিক ও আর্থিক। কিন্তু ভারতের সঙ্গে পদ্মাপাড়ের দেশের সম্পর্ক আত্মিক, হৃদয়ের।
ভারত মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গী। ফলে এই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের রক্তের সম্পর্ক। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ও চাপের কথাও মোদিকে বলেছেন হাসিনা, এমনটাও শোনা যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের বিদেশ সচিব মোমেন জানিয়েছেন, মোদি ও হাসিনার মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কোনও কথা হয়নি। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, সামনেই যেহেতু বাংলাদেশের নির্বাচন, সুতরাং মনে করা হচ্ছে, ওই নির্বাচনের আগে এটি হাসিনার শেষ ভারত সফর। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই সফরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বাংলাদেশের কাছে।
নয়াদিল্লির কাছ থেকে ঢাকা আদৌ কতটা কী আদায় করতে পারল, সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল। তবে শুক্রবারের বৈঠক উষ্ণ আবহেই সম্পন্ন হয়েছে। বাড়ির দরজায় এসে হাসিনাকে স্বাগত জানান মোদি। ছিলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। বৈঠকের পর মোদি এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে। গত ন’বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক। পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও মৈত্রীর প্রতিফলন ঘটেছে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের আলোচনায়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের কিছুক্ষণ পরই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মোদি। তাঁর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ভূকৌশলগত পরিস্থিতির পাশাপাশি আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মোমেন বলেছেন, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের জন্য এবং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য মঙ্গলকর। এ ব্যাপারে ভারতও একমত। গত সাড়ে ১৪ বছরের শাসনকালে আওয়ামি লিগের সরকারের উন্নয়ন যজ্ঞের কথা তুলে ধরেছেন মোমেন। সূত্রের খবর, বৈঠকে হাসিনা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমী দেশের তৈরি করা প্রবল চাপের কথা তুলে ধরেছেন। এতে আঞ্চলিক অসাম্য ও সন্ত্রাসবাদ উৎসাহ পাবে।