দেশের সময় : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণের পর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’, যে হত্যাকাণ্ডে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। সে দিনই গভীর রাতে গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। রাত ১২’টার পর, সরকারিভাবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন শেখ মুজিব। সে বছর ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা হয় এবং সাতদিনের মাথায় ১৭ এপ্রিল কারাগারে থাকা শেখ মুজিবকে ‘রাষ্ট্রপতি’ ঘোষণা করে শপথ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভা।
২৫ মার্চ গ্রেফতারের সেই রাতে স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা, বড় মেয়ে শেখ হাসিনা-সহ মুজিবের গোটা পরিবার ওই বাড়িতেই ছিল। পাক সেনারা তাঁদের উপর চড়াও হয়নি। এমনকী বাড়িটিতে তল্লাশি করেছে বলেও শোনা যায়নি। যদিও তাদের ছোড়া গুলিতে বাড়িটির সামান্য ক্ষতি হয়েছিল। ৭৫-এ মুজিব হত্যার দিনে আঘাত এসেছিল বাড়িটির উপর। তৃতীয় হামলাটি হয়েছিল ১৯৮৯-এর ১০ অগাস্ট রাতে। শেখ হাসিনা ওই রাতে পৈত্রিক বাড়িতে ছিলেন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ, তারও আগে অন্তত তেরো-চোদ্দ বছর ওই বাড়িটিই ছিল বাংলাদেশের আঁতুরঘর। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার প্রতি বঞ্চনার প্রতিবাদে সংগ্রাম, অসহযোগ এবং শেষে স্বাধীনতা তথা মুক্তির আন্দোলনের রূররেখা তৈরি হয়েছিল ওই বা়ড়িটিতে। তাই পাকিস্তানের সেনা ও প্রশাসনের বরাবর নিশানায় ছিল ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ গভীর রাতে এই বাড়ি থেকে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাক সেনারা। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই বাড়িতে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন শেখ মুজিব। ৭ মার্চের ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন এই বাড়ি থেকেই।
টানা নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর আসে বিজয়। দিনটি পালিত হয় বিজয় দিবস হিসাবে। ১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিতে সপরিবারে হত্যা করা হয় দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানকে। তারপর স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত ৫৪ বছরে বাংলাদেশ অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছে।
গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪-এর ৫ অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানও ইতিহাসের অংশ।
৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫-বুধবার রাতে ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নন্বর বাড়িটি ভাঙা শুরু হয়ে তা চলে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ।সেনা বাহিনীর একটি দল সেখানে গেলেও ‘বিপ্লবী ছাত্র-জনতা’ তাদের ধাওয়া করে। প্রাঁণ বাঁচাতে সেনাও সরে যায়। ফলে বিনা বাধায় বা়ড়িটি ভাঙছে উম্মত্ত জনতা।
সেই কারণে ঐতিহাসিক দিনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে ৫ ফেব্রুয়ারি। ধানণ্ডির ৩২ নন্বর বাড়িটি যারা গুঁড়িয়ে দিলেন তারা নিশ্চয়ই আগামী বছর থেকে দিনটি পালন করবেন বাংলাদেশের বুকে পাকিস্তানের বিজয় দিবস হিসাবে।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিকালে ঢাকায় পাকসেনার আত্মসমর্পণের পর থেকে পাকিস্তানের নিশানায় ছিল ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি। পাক কর্তাদের এই বাসনা বয়ে বেড়াতেন, ওই বাড়িটি ধূলিসাৎ করে একদিন যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ তুলবে। সেদিক থেকে ৫ ফেব্রুয়ার, ২০২৫-এর রাতে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে বলাই যায়। বাংলাদেশে যাদের স্বপ্ন, বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হল তারা নিশ্চয়ই চোখ বুজলে দেখতে পাচ্ছেন, ৩২ নন্বর ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে।
অবশ্য বাস্তব চিত্রে অন্য সুর বাজছে । বুধবার রাতে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে হামলার পরে মুখ খুলেছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা তথা বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর অভিযোগ, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে বঙ্গবন্ধু ভবনে আগুন লাগানো হয়। যে কাজ ইউনূসের সরকার করেছে তা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও করেনি বলে জানিয়েছেন হাসিনা। হাসিনার দাবি, বর্তমানে বাংলাদেশের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। যাঁরা এই কাজ করেছেন, তাঁরা হীনমন্যতার পরিচয় দিচ্ছেন।
বুধবার রাতেই বাংলাদেশে দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ভাষণ দেন আওয়ামি লিগের সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখনই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে আবার ভাঙচুর চালিয়ে ওই বাড়িতে আগুন লাগিয়েও দেওয়া হয়। পরে বুলডোজ়ার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ওই বাড়ি। এর আগে, গত বছরের ৫ অগস্টেও হামলা চালানো হয়েছিল ওই বাড়িতে। বুধবার রাতে দেওয়া ভাষণে সেই প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন হাসিনা। তিনি জানান, ওই বাড়িতে যা করা হয়েছে, তা পাকিস্তানের বাহিনীও করেনি।
ঢাকার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িটি ভেঙে দেওয়ার কথা বলার সময়েই কিছুটা ফুঁপিয়ে ওঠেন হাসিনা। কান্নাভেজা গলায় তিনি বলেন, ‘ধানমন্ডির এই বাড়ি থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তারপরেই পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল। তখন এই বাড়িটি লুঠপাট করেছিল করেছিল তারা। কিন্তু বাড়িটা আগুন দিয়ে পোড়ায়নি এবং ভাঙেনি।’
হাসিনা জানান, মুজিবকে হত্যার পরে তাঁর পরিবারের কেউই ব্যক্তিগতভাবে ওই বাড়িটি ব্যবহার করেনি। বাড়িটি সংগ্রহশালা করা হয়। ওই বাড়িতেই এসেছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতা এবং রাষ্ট্রপ্রধানরাও। কেন এই বাড়িটিকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। হাসিনা জানান, তিনি এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা ওই বাড়ির যে স্মৃতিটুকু নিয়ে বেঁচেছিলেন সেটাও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর বিচার বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ করবে বলে জানিয়েছেন তিনি।