দেশের সময়: তিন রাজ্যে বিধানসভা ভোটের ফল হোক কিংবা সাগরদিঘি, বাগদায় কোনও কিছুরই প্রভাব পড়বে না। এখানকার মানুষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের সঙ্গে আছেন। পঞ্চায়েত ভোটে বাগদায় বিরোধীদের ভরাডুবি হবে।
শনিবার কনিয়াড়া-২ পঞ্চায়েতে দলীয় কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে এমনটাই বললেন বাগদার বিধায়ক তথা তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস। তিনি বলেন, সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি মিলে জোট গড়ে যতই ঘোঁট তৈরির চেষ্টা করুক না কেন, লাভ হবে না। ৩৪ বছরে সিপিএম বাগদার জন্য কিছু করেনি। অপূর্বলাল মজুমদারের সময়ে বাগদায় একটা হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটাকেও পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালের রূপ দিতে পারেনি সিপিএম।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বাগদা হাসপাতালে এখন সিজারিয়ান ডেলিভারি শুরু হয়েছে। এখানকার প্রসূতিদের আর বনগাঁ হাসাপাতালে যেতে হয় না। বাগদা হাসপাতালে সংস্কারের কাজ শুরু হচ্ছে। বেড বাড়বে। আমরা যেসমস্ত রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সেগুলির টেন্ডার হয়ে গিয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে। শুধু তাই নয়, দুয়ারে সরকার শিবির থেকে মানুষ প্রচুর সহায়তা পেয়েছেন। কন্যাশ্রী থেকে রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, সবুজসাথী প্রতিটি প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন মানুষ। ফলে বাগদার মানুষ কথা দিয়েছেন, কোথায় কী ভোটের ফল হচ্ছে, তা দিয়ে কিছু এসে যায় না তাঁদের। তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন, আছেন।
কিন্তু সাগরদিঘিতে ভোটের ফল প্রকাশ হওয়ার পর যেমন তৃণমূলের অন্দরে সাবোতাজের তত্ত্ব সামনে আসছে, একাধিক প্রশ্ন উঠছে, বাগদায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে এমন কোনও অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা নেই তো? বিজেপির প্রতীকে জিতে বিধায়ক হয়ে তৃণমূলে ফিরে আসা, জোড়াফুলের জেলা সভাপতি হওয়া, এসব দলের কর্মীরা মেনে নিচ্ছেন তো? মাঝেমধ্যেই শোনা যাচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের একটা অংশ ক্ষুব্ধ, তাঁরা বিক্ষোভও দেখাচ্ছেন।
এই প্রশ্নের জবাবে বিশ্বজিৎ দাস অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, কোথাও কোনও বিক্ষোভ নেই। শনিবার আমি কনিয়াড়া-২ পঞ্চায়েতে কর্মসূচি করেছি। দলের সমস্ত নেতা সেখানে এসেছেন। কর্মীরা ছিলেন। আমি সবাইকে নিয়ে চলছি। আর সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৃণমূলের কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। ডঙ্কা, কাঁসর নিয়ে তাঁরা মিছিলে শামিল হচ্ছেন। প্রকাশ্যেই বলছেন, ঠাকুরবাড়ির উন্নয়নে, হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ ঠাকুরের স্মৃতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা করেছেন, তাতে অভিভূত তাঁরা। ফলে এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাগদায় সব আসনে প্রার্থীই দিতে পারবে না বিরোধীরা। আর ফল প্রকাশের পর দেখা যাবে, তাদের জমানত জব্দ হয়েছে।
এদিকে, দলের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য তথা বাগদার প্রাক্তন বিধায়ক দুলাল বর। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে বাগদায় বিজেপিকে অনুশোচনা করতে হবে বলে তোপ তাঁর। দুলাল বরের কথায়, বাগদার মানুষ বিজেপিকে ভোট দিতে চাইছে। কিন্তু এখানে দলের কোনও গ্রহণযোগ্য নেতা নেই। দলের তরফে যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মানুষের সঙ্গে কোনও সংযোগ নেই। তাঁরা শুধু মঞ্চে উঠে তিলক আর উত্তরীয় পরতে এবং ফেসবুকে মন্তব্য করতেই ব্যস্ত। মানুষের কোনও উপকারে লাগেন না এইসব নেতারা। দলের রাজ্য নেতৃত্বের অবিলম্বে উচিত, মানুষ কাদের নেতা হিসেবে পাশে পেতে চাইছে, তা যাচাই করা। না হলে তৈরি করা জমিতেও পদ্ম ফুটবে না। তাঁর বিস্ফোরক দাবি, সিন্দ্রাণী ও কনিয়াড়া-২ পঞ্চায়েত দু’টিতে বিজেপি জেতা সত্ত্বেও স্থানীয় নেতৃত্বের অহংকারের কারণে হাতছাড়া হয়েছে। ওই পঞ্চায়েত দু’টিতে দলের যেসব নেতা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের ভাবখানা এমন যে, নেতাদের কাছে মানুষ আসবে, মানুষের কাছেও যে নেতাদের যেতে হয়, তা তাঁরা ভাবতেও পারেননি। তার ফল হাতেনাতে পেয়েছে বিজেপি। আমি দলের রাজ্য নেতৃত্বের কাছে তাই অনুরোধ করব, ফেসবুকে ভাষণ দেওয়া কিংবা মঞ্চে উঠে শুধু তিলক আর উত্তরীয় পরা নেতাদের উপর ভরসা না করে, সত্যি যাঁদের সঙ্গে মানুষের যোগ আছে, তাঁদেরকে পঞ্চায়েতের দায়িত্ব দেওয়া হোক। তাতে দলের ভাল হবে।
দল বদলু দুলাল বরকে নিয়েও অবশ্য বিজেপির অন্দরে কোন্দল কম নেই। ২০০৬ সালে তৃণমূলের প্রতীকে জিতে বাগদার বিধায়ক হন দুলাল। এরপর ২০১৬ সালে কংগ্রেস-সিপিএম জোটের টিকিটে জিতে বিধায়ক হন তিনি। কিন্তু আড়াই বছরের মাথায় জোটের ঘর ছেড়ে যোগ দেন গেরুয়া শিবিরে। এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে দল ত্যাগ না করলেও অনেকেই বলছেন, তলে তলে তৃণমূলের সঙ্গেই যোগাযোগ রেখে চলেছেন দুলাল বর। আর সেকারণেই পঞ্চায়েত ভোটের মুখে তিনি এমন বেসুরো। যদিও এতে কোনও লাভ হবে না বলে মনে করেন বিজেপির স্থানীয় নেতৃত্ব।
দুলাল বর অবশ্য বলছেন, অনেকেই অনেক কিছু বলতে পারেন। আমি বিজেপিতেই আছি। এটুকু বলতে পারি, আমি যেভাবে বাগদাকে চিনি, আমার দলের অনেকেই সেভাবেই চেনেন না। তাঁদের সেই মানসিকতাও নেই। এখন দল আমাকে যেখানে যতটুকু দায়িত্ব দিচ্ছে, ডাকছে, সেখানে যাচ্ছি। আমি তো নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে পারি না। বিজেপি সেরকম দল নয়। বিশ্বজিৎ দাস বিজেপির টিকিটে জিতে এখন তৃণমূলে রয়েছেন। বাগদার মানুষ তাঁকে কীভাবে নিচ্ছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে দুলাল বরের সাফ জবাব, বাগদার মানুষ এটা মোটেই ভালভাবে নেয়নি। এমনকী তৃণমূলের লোকজনও এটা মেনে নেয়নি। শাসক দলের নেতাদের রোষে পড়ার ভয়ে মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারছেন না।
বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সাধারণ সম্পাদক দেবদাস মণ্ডলের বক্তব্য, বাগদার মানুষ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। কারণ, তাঁরা গত বিধানসভায় বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। তাঁরা বিশ্বজিৎ দাসকে দেখে নয়, নরেন্দ্র মোদিকে দেখে ইভিএমে বোতাম টিপেছিলেন। বিশ্বজিৎ দাস বাগদার মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। পঞ্চায়েত ভোটে মানুষ এর জবাব দেবেন।
কিন্তু দুলাল বর যে বলছেন, বাগদায় বিজেপির নেতৃত্বের ঘাটতি রয়েছে। দেবদাস মণ্ডলের অবশ্য সাফ জবাব, নেতৃত্বের কোনও ঘাটতি নেই। কর্মীরাও চাঙ্গা আছে। সময় এলেই তা টের পাবে তৃণমূল।
তৃণমূলের বাগদা পশ্চিম ব্লকের এসসি ওবিসি সেলের সভাপতি জয়ন্ত বিশ্বাস অবশ্য বলছেন, কে, কী বলছেন জানি না। তবে বাগদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরনো দিনের দুর্জয় ঘাঁটি। বিগত দিনে আমাদের কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, একথা সত্যি। কিন্তু এখন আর সেসব কিছু নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত শক্ত করাই এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা বাগদা ব্লকের ন’টি পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের আসনে জিতে দিদিকে উপহার দিতে চাই।