দেশের সময় , কলকাতা : একদিকে যখন চলছিল বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার প্রথম সমন্বয় কমিটির বৈঠক, অন্যদিকে তখন প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন ইডি আধিকারিকরা ৷
অভিষেক নিজেই জানিয়েছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইডির তলবের কথা। এই মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো দেশের বাইরে। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দিল্লিতে বৈঠকে যোগ দেবেন, নাকি হাজিরা দেবেন, তা নিয়ে জল্পনা ছিল তুঙ্গে। মঙ্গলবার রাতেই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল ৷
ইডি তলব করায় বুধবার সকালে সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরা দেবেন তিনি। বুধবার কলকাতা হাইকোর্টের রক্ষাকবচ সঙ্গে নিয়ে ইডি দপ্তরে হাজিরা দেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধায়। টানা ৯ ঘণ্টার বেশি সময় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ইডি আধিকারিকরা।জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ৮টা ৫০ নাগাদ সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে আসেন অভিষেক। বললেন, সময় নষ্ট।
সকাল সাড়ে ১১ টা নাগাদ সিজিও-তে ঢুকেছিলেন অভিষেক। সেখান থেকে বেরোলেন রাত পৌনে ৯টা নাগাদ। অর্থাৎ অভিষেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে কোনও কঠোর পদক্ষেপ করল না ইডি।
অভিষেক এও বলেন, “৯ ঘণ্টা কেন ২৪ ঘণ্টা জেরা করলেও আমার কিছু যায় আসে না। ইডির কাছে দাবি করছি, আজ ওদের যা বলেছি তা যেন বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে হুবহু পেশ করে। কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে এটা আমার চ্যালেঞ্জ রইল।”
অভিষেক বোঝাতে চান, পুরোটাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নিয়ে করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এর আগে পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে আমাকে ডাকা হয়েছিল। তখন অপারগতার কথা জানিয়েছিলাম। আজ আবার এমন সময়ে ডেকেছে যেদিন ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক ছিল।
তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক এও জানান, ইন্ডিয়া জোটের নেতারা ফোনে তাঁকে বলেছিলেন ইডির জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বুধবার না যেতে। বরং সমন্বয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে। কিন্তু তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, না তিনি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হবেন। বুক চিতিয়ে যাবেন সিজিওতে।
ইডি দফতর থেকে অভিষেক যখন বেরিয়ে আসেন তখন সিজিও কমপ্লেক্সের বাইরে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। অভিষেক ছাতা মাথায় দিয়ে সাংবাদিক বৈঠকের জন্য হাতে মাইক্রোফোন তুলে নেন। তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, অভিষেক সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত। এবং তিনি বলার জন্যও প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন।
তাঁর সাংবাদিক বৈঠকের মধ্যে অভিষেক কিছুটা সময় ধরে প্রায় বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, গত ৮ বছর ধরে সারদা মামলার তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কী হয়েছে। গত ১৪ মাস ধরে জেল হেফাজতে রয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বিরুদ্ধে কী প্রমাণ হয়েছে। আসলে ইডি-সিবিআই যেভাবে ডাকাডাকি করছে তা একটা প্রথা হয়ে গিয়েছে। ভোট আসলে ডাকাডাকি করবে।
আবার থেমে যাবে। এই কদিন আগে ধূপগুড়িতে বিজেপি হেরেছে, লোকসভা ভোট আসছে, তাই ডাকাডাকি করছে। কিন্তু ইডি-সিবিআইয়ের তদন্তে কেউ ন্যায় বিচার পেয়েছেন তা বলতে পারবে না। সারদা, রোজভ্যালি কাণ্ডে যাঁদের টাকা মার গিয়েছে, তারা তো এখনও বিচার পাননি। আর যাঁরা টিভি ক্যামেরায় টাকা নেবেন, তাঁরা বিজেপিতে যোগ দিলেও সাত খুন মাফ।
একই সঙ্গে এদিন অভিষেক বলেন, “হ্যাঁ, আমি এখনও লিপস অ্যান্ড বাউন্সের সিইও। শিক্ষা দুর্নীতির ১০ পয়সা ওই কোম্পানিতে ঢুকেছে, তা ইডি প্রমাণ করুক। চ্যালেঞ্জ করছি, কোনও দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারবে না সেন্ট্রাল এজেন্সি।”
এদিন ইন্ডিয়া বৈঠকে অভিষেক যেতে পারেননি। কিন্তু বৈঠকে তাঁর জন্য আসন খালি রাখা হয়। তার পর সাংবাদিক বৈঠকে কংগ্রেস নেতা কেসি বেনুগোপাল বলেন, বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। ইন্ডিয়া জোট এই প্রতিহিংসার রাজনীতির নিন্দা করছে।
ইডির অফিসে টানা ৯ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের জিজ্ঞাসাবাদ সামলে সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়েই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ইডির তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে ফেলুদা-জটায়ু জুটির কথাও বললেন অভিষেক। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের কথায়, ইডি-সিবিআইয়ের তদন্তপ্রক্রিয়া অনেকটা জটায়ুর দৃষ্টিভঙ্গির মতো। বললেন, ‘এরা আগে থেকে অপরাধী ঠিক করে নেয় মনে মনে। ঠিক করে নেয় এই ব্যক্তি, বা এই মহিলা, বা এই যুবক-যুবতীর মাথার উপর চাপিয়ে দিতে হবে। তারপর অপরাধ সাজানোর চেষ্টা করে। সেই জন্য কোনওদিন সুরাহা হয় না।’
কিন্তু কেন হঠাৎ ফেলুদা ও জটায়ুর প্রসঙ্গ টানলেন অভিষেক? সত্যজিৎ রায়ের এক অনবদ্য সৃষ্টি হল প্রদোষ মিত্র ওরফে ফেলুদা। তাঁর মগজাস্ত্রের জোরে বড় বড় কেস সামলে দিয়েছেন। আর জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলিও হলেন সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি করা আরও এক চরিত্র। রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক জটায়ু।
রহস্য-উন্মোচনে ফেলুদার অন্যতম সঙ্গী তিনি। যে কোনও বিষয়ে সেই জটায়ু ও ফেলুদার দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক বার বার উঠে এসেছে সত্যজিৎ রায়ের লেখায়। এদিন সেই প্রসঙ্গই টেনে আনেন অভিষেক। বললেন, একবার জটায়ু ফেলুদাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁরা দু’জনেই একই জিনিস দেখছেন। তারপরও ফেলুদা তদন্ত করে প্রকৃত দোষীকে খুঁজে বের করতে পারছেন, কিন্তু তিনি কেন পারছেন না?
অভিষেক বললেন, জটায়ুর সেই প্রশ্নের উত্তরে ফেলুদা বলেছিলেন, তফাৎ দৃষ্টিভঙ্গির। দু’জনেই একই জিনিস দেখছেন, কিন্তু ফেলুদা আগে অপরাধ দেখেন তারপর অপরাধী খোঁজেন। কিন্তু জটায়ু মনে মনে আগে ঠিক করে নেন, কে অপরাধী, তারপর অপরাধ তাঁর উপর জোর জবরদস্তি চাপিয়ে দিতে চান।