‘ভালোবাসা দিতে পারি তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?’ -এই পঙক্তির মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, একজন কবির দৃষ্টি কতোটা প্রখর এবং তার অনুভূতির প্রাবল্য কতোটা সাহসী। তার নিজের সম্বন্ধে নিজে যে উচ্চারণ করেছেন তার মধ্য দিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন নিজেকে।
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন ! বাংলা কবিতার জাদুকর বিনয় মজুমদারের কথা বলছি। ১৭ সেপ্টেম্বর বাঙালিকবি বিনয় মজুমদারের জন্মদিন। ১৯৩৪ সালের এইদিনে তিনি মায়ানমারের মিকটিলা জেলার টোডো নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম বিপিনবিহারী মজুমদার, মায়ের নাম বিনোদিনী। বিনয়রা ছিলেন ছয় ভাই-বোন এবং তিনি ছিলেন সবার ছোট। তার ডাক নাম মংটু।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সেখান থেকে বাবা-মার আর বহু মানুষের সঙ্গে বালক বিনয় চলে আসে অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে, পৈতৃক ভিটায়। ১৯৪২ সালে বিনয় মজুমদারকে স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৪৬ সালে তাকে বৌলতলী উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে দেশভাগ পরবর্তী সময়ে তারা সপরিবারে ভারতের কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি কক্রিক রো-রতে অবস্থিত মেট্রপলিটন ইন্সটিটিউট (বউবাজার ব্রাঞ্চ)-এ নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হবার পরে, ১৯৫১ সালে আইএসসি (গণিত) পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে তিনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন। শোনা যায়, তার পাওয়া নম্বর আজও কেউ নাকি ভাঙতে পারেননি।
১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে, অর্থাৎ ছাত্রজীবন সমাপ্ত হবার কয়েকমাস পরেই এনবিএ থেকে প্রকাশিত হয় ‘অতীতের পৃথিবী’ নামক একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এই বছরেই গ্রন্থজগৎ থেকে বের হয় তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘নক্ষত্রের আলোয়’। বৌলতলি হাই-ইংলিশ স্কুলের ম্যাগাজিনে প্রথম তার কবিতা প্রকাশিত হয়। ত্রিপুরা গভর্নমেন্ট কলেজে অল্পকিছুদিন শিক্ষকতা করার পর স্থির করেন শুধুই কবিতা লিখবেন। লেখা শুরু করেন ‘ফিরে এসো চাকা’ দিয়ে।
বিনয় মজুমদার একাধারে ইঞ্জিনিয়ার, গণিতবেত্তা ও কবি। এ যেন নানা বর্ণের সত্তার এক জীবনে। একজন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি গণিতের নানা কঠিন সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন। যার গাণিতিক সূত্রগুলো ইংল্যাণ্ডের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি পারদর্শী ছিলেন রুশ ভাষায়, যা খুব সহজেই রপ্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গণিত-প্রকৌশল সব বিষয়কে তিনি অতিক্রম করেছিলেন কবিতার কাব্যপ্রতিমা নির্মাণ করে। তার কবিতার মেটাফোর তাই অত্যন্ত শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়ানো।
একই সঙ্গে বলতে হয় তার কবিতার দার্শনিক ভিত্তিও প্রথাগত নয়। তার কাব্য চেতনায় ‘প্রেম-ভালোবাসার চিরায়ত বিষয়টিকে তিনি সাজিয়েছিলেন ভিন্নভাবে। তার কবিতায় তিনি লিখেছেন সেইকথাই তবে তার প্রকাশটা ঠিক ওভাবে নয়। কাব্য ‘ভালোবাসা একমাত্র ভালোবাসা ভরে দিতে পারে মনে/শান্তি এনে দিতে। বিনয় মজুমদার ইঞ্জিনিয়ার অর্থাৎ যন্ত্রশিল্পী হয়েও নিজেকে বিস্তৃত করে হয়ে উঠলেন কথাশিল্পী। এরই মধ্যে কিছুদিন খবরের কাগজে চাকরি করেন আবার ছেড়েও দেন। তারপর কথাশিল্পীর কারখানা গড়ে তুলেছিলেন কলকাতার কফি হাউসে। সেখানে তার বন্ধু ছিল সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
তিনি রুশ ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে শুরু করেন রুশ ভাষার গল্প, কবিতার অনুবাদ। এমনকি লেরমনতভ্ আর পুশকিনের বেশ কিছু কবিতাও তিনি অনুবাদ করেন। তার এই কবিতা অগ্রজ কবি বিষ্ণু দে ও বিমল চন্দ্র ঘোষেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরই পাশাপাশি গণিত চর্চার আশ্চর্য বুৎপত্তি অর্জন করেছিল বিনয় মজুমদার।
আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর একটি গবেষণাপত্র পড়ে এতই বিস্মিত হয়েছিলেন যে সেটিকে তিনি সানন্দে সুপারিশ করেছিলেন মহাফেজ খানায় রক্ষা করার জন্য। গণিতের পঠন-প্রক্রিয়া বা স্ট্রাকচার বরাবরই তার কবিতাকে ও আঙ্গিককে এক ধরনের আদল দিয়েছে। যাকে বলে ‘অ্যাক্সিওমেটিক ট্রুথ’।
অনেক নিপাট প্রেমের পদ্য লিখেছেন তিনি। যেগুলো শুধু প্রেমের কবিতাই নয়, সঙ্গে আরও কিছু। অনেকেরই মতো বিনয় মজুমদার গণিতের রসবোধে পুরো একটি কাব্যগ্রন্থ লিখলেন শুধুই প্রেম নিয়ে। কাব্যগ্রন্থের নামেও রয়েছে চমক ‘ফিরে এসো, চাকা’। চাকা- ভালোবাসাকেও কতোটা জ্বালা কতোটা মুগ্ধতা দিয়েছে বিনয় মজুমদার তার প্রেমের কবিতায় সেকথা দ্ব্যর্থহীনভাষায় তুলে ধরেছেন।
এক আজব স্বভাবের মানুষ ছিলেন বিনয় মজুমদার। তিনি হঠাৎ একবার ভাবলেন পূর্ব বাংলায় আসবেন, তবে পাসপোর্ট ছাড়াই। তখন পাসপোর্ট চালু হয়ে গেছে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে। ইচ্ছেমতো যাওয়া আসা চলে না। কিন্তু বিনয় মজুমদারের একই কথা তিনি যাবেন পাসপোর্ট ছাড়াই।
সবাই বোঝালেন কিন্তু তিনি মানলেন না, তার ভাষায়- ‘যেখানে আমি আমার বাল্যকাল কাটিয়েছি সেখানে পাসপোর্ট নিয়ে ঢুকতে কেউ আমাকে বাধ্য করতে পারে না।’ নিজের মনমতো কাজ করলেন আর পাকিস্তানে ঢুকতে গিয়ে গ্রেফতার হলেন বিনয়। অবশেষে জেল খেটে ফিরে যান কলকাতায়।
কবিতা আর গণিতে এক লড়াই চলে বিনয় মজুমদারকে নিয়ে। তিনি লাল খাতার পর হলুদ খাতা, হলুদের পর সবুজ-কখনো কখনো দিনে পঞ্চাশ ষাট পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখতেন। লিখতেন ইংরেজিতে, মলাটে কোনো খাতার নাম ‘কনিক সেকশন’ কোনোটা ‘ইন্টার পোলেশন সিরিজ’। আর গণিত চর্চার অবসরে চলতো কাব্য ভাবনা। মৃত্যুর বছর খানেক আগে তিনি বলেছিলেন- ‘আর কবিতা লিখব না, অন্তত এক বছর না, তার বদলে অঙ্ক কষব। একটা নতুন সিরিজ মাথায় এসেছে তাকে ঝালিয়ে দেখতে হবে।’
বিনয় কোনো রকম প্রতিষ্ঠার পেছনে ছোটেননি। নিজের মতোই কাটিয়ে দিয়েছেন একটা জীবন। তার কবিতার সঙ্গে জীবনযাপন মিলে গিয়েছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে। কবিতায়ই যেন তার ধ্যান হয়ে উঠেছিল। তিনি জার্মানের বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় আর জাপান থেকে আহ্বান পেয়েছিলেন গণিতে অধ্যাপনার জন্য।
লন্ডন থেকে ডাক পেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য। কিন্তু সব কিছু ছেড়ে তিনি রয়ে গেলেন পাখিডাকা সবুজের আহ্বানে ঠাকুরনগর-শিমুলপুরের নিভৃত আশ্রমে। শেষ জীবনে প্রকৃতির একদম কাছাকাছি থেকে লিখেছিলেন- ‘আমরা এখন সাগরে-আকাশে সঞ্চারিত হতে চাই। আমরা পাখিদের আকাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু পাখিদের কাছে যাওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি।’ লিখেছেন- ‘হায় হাসি, হায় দেবদারু/মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।’
তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার, একাডেমি পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ পুরস্কার, কবিতীর্থ পুরস্কার, কীর্তিবাস পুরস্কার অর্জন করেছেন তার কাব্যগ্রন্থ নক্ষত্রের আলোয়, গায়ত্রীকে, ফিরে এসো, চাকা, আমার ঈশ্বরীকে, অঘ্রাণের অনুভূতিমালা-র জন্য। তিনি তার কবিতা সম্পর্কে বলেন, ‘আমার সব কবিতাই আসলে দিনপঞ্জি।’
তিনি দীর্ঘ রোগভোগের পরে ২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্বমানের কবি আর গণিতজ্ঞ বিনয় মজুমদার কবিতার জগতে প্রবেশ করেছিলেন নিঃশব্দে আবার প্রস্থানও করলেন নিঃশব্দে। কিন্তু রেখে গেলেন তার অসংখ্য কীর্তি।