বাংলাদেশ পরিস্থিতিই কি বাড়াল চাপ? তাতেই কি সীমান্ত এলাকায় জমি জোগাড়ে এল গতি—জমি জটে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকা বাংলাদেশ সীমান্ত সুরক্ষার কাজে রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক তৎপরতায় এই চর্চাই শুরু হয়েছে প্রশাসনের অন্দরে।
কাঁটাতার নেই উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা ব্লকের সীমান্তবর্তী এক বিস্তীর্ণ এলাকায়। এই এলাকায় কাঁটাতারের জন্য প্রয়োজন জমি ও তার চিহ্নিতকরণ। মঙ্গলবার গাইঘাটা ব্লক অফিসে এবিষয়ে বিএসএফ-এর সঙ্গে একটি বৈঠক করে গাইঘাটা ব্লক প্রশাসন। গাইঘাটার বিডিও নীলাদ্রি সরকার এবং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ইলা বাগচি ছাড়াও বৈঠকে ছিলেন বিএসএফ-এর ৫ এবং ১৪৩ নম্বর ব্যাটালিয়নের আধিকারিকরা। ছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের অন্যান্য আধিকারিকরা।
এবিষয়ে বিডিও বলেন, ‘রামনগর এবং ঝাউডাঙা গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে রয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। এই এলাকায় কাঁটাতার দেওয়ার প্রয়োজনে প্রায় ১০০ একর জমি কেনা হবে। জমি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই এবং কেনার কাজও শুরু হয়েছে।’
উপস্থিত পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ইলা বাগচি জানান, কাঁটাতারের জন্য কোনও জমিজট নেই। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই জমি মাপা হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকেই সীমান্তে বেড়া দেওয়া নিয়ে একাধিকবার বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি’র সঙ্গে কোথাও বিএসএফ, আবার কোথাও স্থানীয় গ্রামবাসীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে। এদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসকারী গ্রামবাসীদের অভিযোগ, কোথাও কোথাও সীমান্তে বেড়া না থাকার সুযোগ নিয়ে পড়শি দেশ থেকে এপারে এসে তাঁদের ফসল লুট করে নিয়ে গিয়েছে সে দেশের দুষ্কৃতীরা।
সম্প্রতি মালদহের বৈষ্ণবনগরে সীমান্তে বাংলাদেশিরা ভারতে ফসল লুট করতে এলে রুখে দাঁড়ান ভারতীয় গ্রামবাসীরা। এগিয়ে আসে বিএসএফ। কিন্তু অভিযোগ, বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা শুধুমাত্র ওই ঘটনায় বিএসএফের দিকে পাথর বৃষ্টি নয়, বোমাও ছোঁড়ে।
বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকায় জমি জোগাড়ে এল গতি—জমি জটে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকা বাংলাদেশ সীমান্ত সুরক্ষার কাজে রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক তৎপরতায় এই চর্চাই শুরু হয়েছে প্রশাসনের অন্দরে।
অতীতে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা চলেছে। টানাপড়েন, দোষারোপ আর পাল্টা দোষারোপের ঘটনাও ঘটেছে হামেশাই। কিন্তু বাংলাদেশ-সীমান্ত সুরক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ তুলে এসেছে কেন্দ্র এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। প্রশাসনের অন্দরের খবর, জমি জোগাড়ের জট কাটাতে কার্যত নিঃশব্দেই তৎপর হয়েছে নবান্নের সর্বোচ্চ মহল। মন্ত্রিসভার নানা বৈঠকে বিধি পাশ করিয়ে জমি কিনে তা সীমান্ত সুরক্ষার জন্য দেওয়ার অনুমতি একাধিক জেলা প্রশাসনকে ইতিমধ্যেই পাঠিয়েছে নবান্ন। পাশাপাশি, সীমান্তবর্তী কোন জেলায় জমি-জট কী পরিস্থিতিতে রয়েছে, তারও রিপোর্ট চেয়েছে নবান্ন। ঘটনাচক্রে, এটা এমন সময়ে হয়েছে, যখন বাংলাদেশে ক্ষমতার বদল ঘটেছে নাটকীয় ভাবে। সে দেশের জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে বা পালিয়ে গিয়েছে বহু জঙ্গি-নেতা। সূত্রের দাবি, তার পরে এ রাজ্যের সঙ্গেও পরিস্থিতি নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছে কেন্দ্র। কারণ, অবস্থানগত ভাবে ভারত–বাংলাদেশের মধ্যে এ রাজ্যের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাক্তন এক আমলার কথায়, “বাংলাদেশের পরিস্থিতি যা, তাতে এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল। অনেকগুলি দেশের সীমান্ত এ রাজ্যের সঙ্গে রয়েছে। ফলে বিস্ফোরক, জাল অর্থের প্রবেশ থেকে জঙ্গি অনুপ্রবেশ— সব প্রশ্নেই সীমান্তে স্থায়ী পরিকাঠামো জরুরি।” এ প্রসঙ্গে এক কর্তা বলেন, “এমন সমস্যা বাড়লে নিয়মিত এনআইএ বা এনএসজি-র আনাগোনা বাড়বে রাজ্যে। তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। ফলে দ্রুত পদক্ষেপ করার নির্দেশ রয়েছে।”
প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রায় ৪০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা রয়েছে। তার মধ্যে অসমে ২৬২, ত্রিপুরায় ৮৫৬, মিজ়োরামে ৩১৮, মেঘালয়ে ৪৪৩ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে সে দেশের সঙ্গে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত এলাকার দৈর্ঘ্য প্রায় ২২১৭ কিলোমিটার। কেন্দ্র ওই সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের সুরক্ষা দিতে দীর্ঘদিন ধরেই রাজ্য সরকারের থেকে জমি চাইছে। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ এ রাজ্যের নীতিতে না থাকায় (মালিকের থেকে সরাসরি জমি কেনাই রাজ্যের নীতি) সেই কাজ এগোচ্ছিল কার্যত শম্বুকগতিতে। অতীতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বা বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু জমি জোগাড়ে গতি আসেনি। এত দিনে প্রায় ১৬৪৫ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতার দেওয়া গিয়েছে। প্রায় ৪৩৫ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতার দেওয়া বাকি। গত বছরের শেষে সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলার শুনানিতে সরাসরি এ রাজ্য সরকারের এমন ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল কেন্দ্রও।