দেশের সময় : পেট্রাপোল থেকে দুবাই। অল্প কয়েক বছরেই শঙ্কর আঢ্য ওরফে ডাকুর বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার কীভাবে? কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। কীভাবে হল? রহস্য এখানেই!
গোটা বিষয়টি যেমন ইডি আধিকারিকদের স্ক্যানারে, তেমনই বনগাঁর মানুষের মধ্যেও এনিয়ে চর্চার শেষ নেই। ডাকুর বিরুদ্ধে পূর্ত দফতরের জলাজমি ভরাট করে বেআইনিভাবে হোটেল তৈরির অভিযোগ উঠেছে আগেই। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের জমিতে বেআইনিভাবে ভবন তৈরি করে তা লিজ দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া জোর করে জমিবাড়ি লিখিয়ে নেওয়া, বেনামে দীঘায় হোটেল চালানো, ভুয়ো মুদ্রা বিনিময় সংস্থা এসব অভিযোগও সামনে এসেছে ইতিমধ্যেই।
এবার নতুন অভিযোগ। শঙ্কর আঢ্য বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালীন খাতায়-কলমে যে সংখ্যক ট্রাক পুরসভার পার্কিংয়ে দেখানো হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পণ্যবাহী ট্রাক পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গিয়েছে বলে অভিযোগ। এবং কখনও পিছনে থাকা ট্রাক আগে সীমান্তে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে কখনও বা সামনে থাকা ট্রাককে দাঁড় করিয়ে রেখে হাজার হাজার টাকা ডিটেনশন চার্জ নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন এক্সপোর্টারদের অনেকে। টাকার অঙ্কটা মোটেই কম নয়। কোনও ট্রাকের কাছ থেকে দশ হাজার, কোনও ট্রাকের কাছ থেকে আবার আদায় করা হয়েছে কুড়ি হাজার টাকা। প্রতিদিন কয়েকশো করে ট্রাক বাংলাদেশে যায়।
বছরে অন্তত ২০০ দিন এক্সপোর্ট ইমপোর্ট চলে পেট্রাপোল দিয়ে। ফলে পাঁচ বছরে টাকার অঙ্কটা কয়েকশো কোটি। প্রশ্ন উঠেছে, সেই টাকা কোথায়? সব টাকা কি জমা পড়েছে পুরসভার তহবিলে? নাকি ওই টাকা চলে গিয়েছে কারও পকেটে?
এই এক্সপোর্টারদের দাবি, তদন্ত করলেই সবটা ফাঁস হয়ে যাবে। পার্কিংয়ের টাকা কোথাও গেল? পুরসভার নাম করে যে টাকা আদায় করা হল, সেই টাকা কি পুরসভায় আছে? নাকি হাপিস হয়ে গিয়েছে।
পেট্রাপোল এক্সপোর্টার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মীর আবদুল হাসেমের অভিযোগ, গত পনেরো বছর ধরে বনগাঁয় পার্কিংয়ের নামে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে যেভাবে ১০ হাজার ২০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে, তা সবাই জানেন। এর পিছনে অদৃশ্য হাত ছিল। কোথায় গেল সেই টাকা? পেট্রাপোল সীমান্তে মাফিয়ারাজ চলেছে। কোনও কারণ ছাড়াই দিনের পর দিন ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কখনও বলা হয়েছে, লিঙ্ক নেই।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক্সপোর্টারদের অনেকেই এনিয়ে তদন্ত দাবি করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ওইসময় তাঁরা যে পরিমাণ লোকসান করেছেন,তাতে তাঁদের ব্যবসা একেবারে বসে গিয়েছে। আর সামাল দিতে পারেননি। বাধ্য হয়ে অনেকে লরি বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেকে আবার এক্সপোর্ট, ইমপোর্ট ছেড়ে দিয়েছেন। প্রতিবাদ করলে হুমকি এসেছে। মারধরও করা হয়েছে।
এক্সপোর্ট দেরি হচ্ছে। কোনও আবার কোনও কারণ বলা হয়নি। এক একটা গাড়িকে ৩০-৪০ দিন দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।
টাকা দিতে দিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ট্রান্সপোর্টার, এক্সপোর্টাররা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছেন। প্রতিবাদ করলেই দেখে নেওয়ার হুমকি এসেছে। মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অদৃশ্য হাতের অঙ্গুলিহেননে আমাদের সংগঠনের নাম ভাঙিয়েও অনেক কিছু হয়েছে সেসময়।
বনগাঁ পুরসভার বর্তমান চেয়ারম্যান গোপাল শেঠ অবশ্য জানিয়েছেন, আগের বোর্ডের আমলে কী হয়েছে জানি না। আমার আমলে কীভাবে কাজ হয় তা বনগাঁর মানুষ জানেন। প্রত্যেক কাউন্সিলর জানেন।
বনগাঁর প্রাক্তন চেয়ারম্যান শঙ্কর আঢ্য কতটা গভীরে ছড়িয়েছিলেন দুর্নীতির শিকড়? এখন সেটাই খুঁজে বের করতে মরিয়া কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। রেশন দুর্নীতির তদন্তে ইতিমধ্যেই ডাকুর গোটা পরিবার ইডির স্ক্যানারে।
বনগাঁর এই প্রাক্তন তৃণমূল চেয়ারম্যানের মা, মেয়ে এবং তাঁর ভাইয়ের স্ত্রীকে ডেকে ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন ইডি কর্তারা। তাতে বেশকিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি ইডির।
কেন্দ্রীয় এজেন্সির অনুমান, শুধু শঙ্কর আঢ্য নন, তাঁর গোটা পরিবারই রেশন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। সেকারণেই পরিবারের সদস্যদের তলব করা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে সেই দুর্নীতি হয়েছে, এখন সেই তথ্য প্রমাণ হাতে পেতেই মরিয়া তদন্তকারী সংস্থার কর্তারা। যদিও শঙ্কর আঢ্যর পরিবারের দাবি, গোটাটাই চক্রান্ত। কোনওরকম দুর্নীতির সঙ্গে তারা যুক্ত নন। তাদের ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। শঙ্কর আঢ্যকেও ফাঁসানো হচ্ছে। তদন্তে তারা পুরোপুরি সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
আইএনটিটিইউসির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি নান্টু ঘোষ বলেছেন, ‘‘ওই আমলে পার্কিংয়ে কী হয়েছে, তা ট্রাক চালক, খালাসি থেকে ট্রান্সপোর্টার, এক্সপোর্টার এমনকী রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী সব জানেন। আমি এনিয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’
তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ দাসের বক্তব্য, ‘‘পুরসভায় কী হয়েছে, তা পুর কর্তৃপক্ষই বলতে পারবে। দলের সভাপতি হিসেবে বলতে পারি, সবটাই তদন্ত সাপেক্ষ।’’
এদিকে, রেশন দুর্নীতির তদন্তে ইডি আধিকারিকরা ইতিমধ্যেই ৯৫টি বিদেশি মুদ্রা বিনিময় সংস্থার হদিশ পেয়েছেন। ইডি সূত্রে খবর, এরমধ্যে ৫টি সংস্থা রয়েছে শঙ্কর আঢ্য ও তাঁর পরিবারের নামে। বাকিগুলি ভুয়ো। ওইসব ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমে কত কালো টাকা সাদা করা হয়েছে, সেটাই এখন খুঁজছে ইডি। পাশাপাশি তারা খতিয়ে দেখছে দুবাই ছাড়া আর কোন কোন দেশে রেশন দুর্নীতির টাকা পাচার হয়েছে। সেসব টাকা ঠিক কী কাজে লাগানো হয়েছে। পেট্রাপোলে ঢুঁ মারলে দেখা যাচ্ছে, বেশকিছু মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রের দরজা বন্ধ। কেন সেগুলি বন্ধ তা নিয়েও দেখা গিয়েছে জল্পনা।
এক সপ্তাহ আগে শঙ্কর আঢ্যকে গ্রেফতার করেছে ইডি। তাঁকে গ্রেফতারের পরই চাঞ্চল্যকর দাবি করা হয়েছে ইডির তরফে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, রেশন দুর্নীতি কাণ্ডে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এরমধ্যে ২ হাজার কোটি টাকা শঙ্কর আঢ্যর হাত ধরে পাচার হয়েছে দুবাইয়ে।
রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের একটি চিঠির সূত্র ধরে শঙ্কর আঢ্যকে গ্রেফতার করে ইডি। এদিকে ডাকু গ্রেফতার হতেই তাঁর সম্পত্তি নিয়ে তুমুল চর্চা শুরু হয়েছে। সামান্য একজন চা বিক্রেতা থেকে কী করে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি। পথে নেমেছে সিপিএমও। শঙ্কর আঢ্যের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে হোটেল ব্যবসার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে বামেরা। বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তথা কাউন্সিলর দেবদাস মণ্ডলের অভিযোগ, ২০১৫ সালে চেয়ারম্যান থাকাকালীন ক্ষমতাবলে ইছামতী নদী থেকে বালি তুলে, সেই বালি দিয়ে জলাজমি ভরাট করে পূর্ত দফতরের জমিতে অবৈধভাবে হোটেল তৈরি করেছেন শঙ্কর আঢ্য।
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। তাই সব দেখেও হাতগুটিয়ে থেকেছে প্রশাসন। বছরে মাত্র ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বনগাঁ পুরসভার কাছ থেকে ৯৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়ে হোটেল ব্যবসা চালানো হচ্ছে। এই দুর্নীতির পিছনে রয়েছেন শঙ্কর আঢ্য ও তাঁর পরিবার। এছাড়াও আরও দু’চারজন রয়েছেন এর পিছনে। তদন্তের স্বার্থে আমি এখনই তাদের নাম বলতে চাইছি না। পুরসভা ও পূর্ত দফতরের কাছে আমাদের দাবি, যেভাবেই হোক ওই জলাজমি ফেরাতেই হবে। না হলে বনগাঁর মানুষকে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন হবে।
ব্যক্তিগত আক্রমণ করে শঙ্কর আঢ্যকে দেবদাস মণ্ডলের তোপ, ডাকু নামটি যেই দিয়ে থাকুন না কেন, তিনি হয়তো জেনেবুঝেই দিয়েছিলেন যে, এই ডাকু একদিন বনগাঁর ডাকাত হবে। আর গোটা দুর্নীতির পিছনে তৃণমূলের কিছু নেতার প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে, না হলে আড়াই কোটি টাকার মন্দির, তিন কোটি টাকার লেকটাউনে বাড়ি, এসব হয় কী করে। সিপিএম নেতৃত্বের অভিযোগ, শঙ্কর আঢ্য পুরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালীন বনগাঁয় ত্রাসের রাজত্ব, আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করছিলেন। মানুষ ভয়ে মুখ খুলতে পারতেন না। তোলাবাজি, খুনখারাপি কিছুই বাদ যায়নি।