দেশের সময় , দত্তপুকুর : রবিবার সাতসকালেই ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুর বাজি কারখানায় সেই বিস্ফোরণের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের। সূত্রের খবর এই মৃতদের মধ্যেই নাকি নাম রয়েছে খোদ বাজি কারখানার মালিক কেরামত আলির ছেলের রবিউল আলির! মারা গিয়েছেন কারখানার জমির মালিক শামসুল আলিও।
কিন্তু এই ঘটনার পরেই মালিক কেরামতকে নিয়ে বিস্ফোরক তথ্য হাতে এসেছে তদন্তকারীদের। জানা গেছে, এই কেরামতকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল মে মাসে এগরার ঘটনার পরে। বেআইনি বাজি কারবারের অভিযোগে জেল খেটেছিল সে। জামিনের পরে আবার একই বেআইনি কাজ শুরু করে। এবার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল দত্তপুকুরে।
স্থানীয়রা বলছেন, এত কারবার ও লোভের ফল ভাল হল না কেরামতের। মাশুল দিতে হল ছেলের জীবন দিয়ে।
প্রশ্ন উঠেছে, এত কিছুর পরেও কীভাবে আবার বেআইনি কারবার শুরু করল কেরামত আলি! স্থানীয় সূত্রের খবর, এই কেরামত, যাকে মনে করা হচ্ছে এই পুরো ঘটনার পিছনে মূল কান্ডারি, তার শুধু একটা বাড়িতেই এই বেআইনি কাজ হত না। আশেপাশের আরও তিন-চারটে বাড়িতেও এই বেআইনি কাজ করা হত। জানা যাচ্ছে, ওই বাড়িগুলো কেরামত ভাড়া দিত এই কাজেই।
তবে বারবার ঘুরেফিরে একটাই প্রশ্ন উঠছে,
গত চার মাসে রাজ্যে বড় বড় চার বিস্ফোরণে
এত মৃত্যুর পরেও প্রশাসনের টনক কেন নড়ল না?
স্থানীয়রা বলছেন, এর আগেও এরকম বিস্ফোরণ হয়েছে দত্তপুকুরে। কেউ মারা যায়নি বলে জানাজানি হয়নি। তবে আপত্তি উঠেছে বহুবার। কারও কথাই শোনা হত না বলে অভিযোগ। দাবি, এর আগেও বাজি কারবারিদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলায় অনেকে জখম হয়েছে, মারা গেছে। নিজেরাই হাসপাতালে নিয়ে নিয়ে লুকিয়ে চিকিৎসা করে নিয়ে আসত বলেও দাবি করেছেন এলাকাবাসীদের একাংশ।
কিন্তু এবার আর লুকোছাপার জায়গা নেই। ভয়াবহ বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিয়েছে গোটা রাজ্যকে। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে সেই সময় কর্মরত শ্রমিকদের দেহ তালগোল পাকিয়ে ছিটকে পড়েছিল ১৫০ মিটার দূরে। কোনও দেহ আবার আটকে গিয়েছিল কারখানার চিলেকোঠায়, পেয়ারা গাছে।
এই ঘটনায় স্থানীয়রা সরাসরি তৃণমূলের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। নাম উঠেছে খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষেরও। যদিও রথীন ঘোষের দাবি, এর পিছনে রয়েছে আইএসএফ আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। রমজান আলি নামে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের এক নেতার নাম করে তিনি জানান, রমজান সহ আইএসএফের আরও অনেকে রয়েছে এই ঘটনার পিছনে। এ ব্যাপারে তিনি কিংবা পুলিশ কেউই কিছু জানত না বলে দাবি করেছেন খাদ্যমন্ত্রী।
রাজ্যে ইদানীংকালে আরও কয়েকটি জায়গায় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হলেও ভয়াবহতায় দত্তপুকুর অনেকটা এগরার মতো। পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় বিস্ফোরণ হয় গত ১৬ মে। এর পরেই রাজ্যের সর্বত্র সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে বলে নবান্ন। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এর পরে নবান্নর পক্ষে নির্দেশে বলা হয়েছিল, রাজ্যের সমস্ত বেআইনি বাজি কারখানার বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণ মানুষকে এই ধরনের কারখানায় কাজের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করতে হবে। পাশাপাশি, বেআইনি বাজি কারখানার কর্মীদের বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরির কথাও বলা হয়।
নবান্নের তরফে নির্দেশিকায় পুলিশ সুপার এবং কমিশনারদের বলা হয়, বেআইনি বাজি তৈরির সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে চলা বাজি কারখানাগুলিতে তল্লাশি চালাতে হবে। বেআইনি বাজি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বাজেয়াপ্ত করা বাজি কী ভাবে নষ্ট করতে হবে, তা-ও জানিয়ে দেয় নবান্ন। বলা হয়েছিল, বাজেয়াপ্ত বাজি আদালতের নির্দেশ মেনে নষ্ট করতে হবে। বিপুল পরিমাণ বাজি উদ্ধার হলে প্রয়োজনে অল্প অল্প করে তা নষ্ট করতে হবে।
বেআইনি বাজি প্রস্তুতকারকেরা যাতে আবার একই কাজ না করেন, তা স্থানীয় থানাকে নিশ্চিত করতে হবে বলেও নির্দেশ দেয় নবান্ন। এগরায় মূল অভিযুক্ত ভানু বাগ বিস্ফোরণের পরে ওড়িশার হাসপাতালে মারা যান। তিনি অতীতেও বাজি কারখানা চালাতেন। পুলিশ গ্রেফতার করলেও মুক্তি পেয়েই আবার তিনি বাজির কারবার শুরু করে দেন। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখতে নবান্ন স্পষ্ট জানিয়েছিল, বেআইনি বাজি প্রস্তুতকারকেরা যাতে আবার একই কাজ না করেন, তা দেখতে হবে স্থানীয় থানাকেই।
সব বাজি কারখানার বিস্ফোরণের পর দেখা যায়, সেখানে শ্রমিকের কাজ করেন মূলত স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। রাতারাতি কারখানা বন্ধ হলে তাঁদের রোজগার যাতে বন্ধ না হয়ে যায়, তার জন্য প্রয়োজন মনে করলে স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে কর্মীদের অন্যত্র পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে তাঁরা বেআইনি বাজি কারখানায় কাজ না করেও সুস্থ ভাবে জীবনধারণ করতে পারেন। সর্বোপরি সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পরামর্শ পুলিশ প্রশাসনকে দিয়েছে নবান্ন।
১৮ মে এই নির্দেশ জেলায় জেলায় পাঠিয়েছিল নবান্ন। কিন্তু তাতে যে কাজের কাজ বিশেষ হয়নি, তারই প্রমাণ মিলল দত্তপুকুরের দুর্ঘটনায়। স্থানীয়রা বলছেন, এখানে কারা বাজি বানায়, কারা কাজ করে— সবটাই পুলিশের জানা ছিল। নির্ভয়ে চলত অবৈধ কারখানা। তারই খেসারত দিত হল রবিবার সকালে।
ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্তভার নিয়েছে সিআইডি। ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছেছে বম্ব স্কোয়াড এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনাস্থল থেকে বেআইনি বিস্ফোরক মজুত থাকার প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারীরা। এলাকাবাসীর দাবি, সব ক’টা বাড়ি মিলিয়ে এখনও এত বিস্ফোরক মজুত রয়েছে, তাতে গোটা এলাকা উড়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে সিআইডি ও বম্ব স্কোয়াড এসে পরীক্ষা করছে, এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এখনও কোনও বিস্ফোরক আছে কিনা।
দত্তপুকুরের বাজি কারখানার বিস্ফোরণের ঘটনায় ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি বা এনআইএ-কে দিয়ে তদন্তের দাবি তুলেছে বঙ্গ বিজেপি।
এবার এই দাবি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ৷
রবিবার বিকেল গড়াতে না গড়াতেই, রাজ্য বিজেপি এনআইএ তদন্তের জন্য একেবারে কেন্দ্রের কাছে দরবার করল। শাহকে লেখা চিঠিতে সুকান্ত দাবি করেছেন, ‘দত্তপুকুরের ঘটনা খুবই মর্মান্তিক। অনেক প্রাণ ও সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে। স্থানীয় মানুষ বলছেন, এই ঘটনায় ৬-৭ জন মারা গেছেন। ভবিষ্যতে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।’
সেইসঙ্গে চিঠিতে সুকান্ত ‘পুলিশি উদাসীনতা’র অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর দাবি, স্থানীয়দের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এই ঘটনার তদন্তভার এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়া হোক। এনআইএ এই ঘটনার পুঙ্খানপুঙ্খ তদন্ত করবে। এমনকী এই বিস্ফোরণের সঙ্গে কোনও জঙ্গি-যোগ রয়েছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখতে পারবে। শেষে সুকান্ত লেখেন, ‘নিহত পরিবারদের সদস্যরা ও আহতরা সুবিচার চায়।’