বনবাসী, গিরিবাসী জনজাতির সঙ্গে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল শ্রীরামচন্দ্রের; সেই সঙ্গে প্রাচীন ভারতের সনাতনী সুশাসকবৃন্দের। কৃত্তিবাসী রামায়ণ নিয়ে বামপন্থীদের যথেষ্ট অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ কাজ করে। তার একটি ছোট্ট পরিচয় তুলে ধরা যাক। মহাশ্বেতা দেবী উল্লেখ করেছেন, “কৃত্তিবাসের রামায়ণে আলাদা করে কোনো অন্ত্যজ ভাবনা থাকতে পারে না। তিনি সংস্কৃত রামায়ণ অসামান্য ভাষায় ও ছন্দে বাংলায় লিখেছিলেন মাত্র।” (দেবী মহাশ্বেতা ১৩৯৫ কৃত্তিবাসের রামায়ণে অন্ত্যজ ভাবনা, কবি কৃত্তিবাস সংকলন গ্রন্থ, ফুলিয়া-বয়রা, নদীয়া, পৃষ্ঠা ১৫১)।
কিন্তু সত্যিই কী তাই?
১. শ্রীরামের সঙ্গে চণ্ডাল গুহকের মিতালি কবি কৃত্তিবাস যে ভাষায় আলোচনা করেছেন, তার পর মহাশ্বেতা দেবীর উচিত হয় নি, কৃত্তিবাসে অন্ত্যজ ভাবনা অনুপস্থিত। কৃত্তিবাস লিখছেন, “চণ্ডাল বলিয়া যদি ঘৃণা কর মনে/পতিত পাবন নাম তবে কি কারণে।”
মনে রাখার মতো বিষয়, কৃত্তিবাস যখন এমন কথা লিখছেন, তখনও আবির্ভূত হন নি সাম্যবাদী ভক্তি আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ শ্রীচৈতন্য। এমন শ্রুতকীর্তি মানুষকে নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর ‘সাড়েচ্ছয়ানা’ মন্তব্য আমাদের ব্যথিত করে।
২. সুগ্রীবের সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের সখ্যতা, বানরকূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কীসের ঈঙ্গিতবাহী? ৩. অন্ত্যজ শবীরের হাতে শ্রীরামচন্দ্র ফল গ্রহণ করছেন, সেই জায়গাতেও কৃত্তিবাস মুন্সিয়ানায় পরিচয় দিয়েছেন।
রামায়ণের শিকড় যে কতটা মজবুত তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে নানান বনবাসী কৌমগোষ্ঠীর পুরাণকথাতেও। একটি উদাহরণ দিই। বিরহড় লোককথা, ‘রাম-সীতা-হনুমান’ গল্প। সেখানে তেঁতুল আর খেজুর পাতার অভিযোজনের গল্প, তারমধ্যে শ্রীরামচন্দ্র সম্পৃক্ত। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা বনে চলে গেল। সেখানে তারা ‘উথ্লু’ বিরহড়দের মতো যাযাবরের জীবন কাটাতে লাগল। থাকত পাতার ছাওয়া কুঁড়ে ঘরে।
একবার একটা মস্ত বড় তেঁতুল গাছের তলায় ঘর তৈরি করল তারা। সেই সময় তেঁতুল গাছের পাতা ছিল মস্ত বড় বড়; ভেতর দিয়ে রোদ ঢুকতে পারত না। রাম ভাইকে বলল, আমরা বনবাসে এসেছি, এখানে কষ্টে থাকতে হবে, আরাম করা চলবে না। কিন্তু এই গাছের ছায়ায় আমরা সুখে আছি, আমাদের গায়ে রোদ বৃষ্টি লাগছে না। এটা তো ঠিক নয়। তুমি তীর মেরে পাতাগুলোকে চিরে দাও। লক্ষ্মণ তীর মেরে তেঁতুল পাতাগুলোকে চিরে ফালাফালা করে দিল।
একটা পাতা চিরে অনেক ছোট ছোট পাতা হয়ে গেল। সেই পাতার মধ্যে দিয়ে বৃষ্টির জল আর রোদের তাপ তাদের দেহে লাগল। সেইদিন থেকেই তেঁতুল পাতা এত ছোট ছোট হয়ে গেল। আবার চলেছে তিনজন বনপথ দিয়ে। এবার তারা ঘর তৈরি করল খেজুর গাছের নিচে। সেইকালে খেজুর পাতা ছিল খুব লম্বা আর চওড়া। বৃষ্টির জল আটকে দিত সেই পাতা। রাম আবার ভাইকে তীর ছুঁড়তে বলল। লক্ষ্মণ তীর মেরে খেজুর পাতাকে সরু সরু করে দিল। সেইদিন থেকে খেজুর পাতা সরু সরু হয়ে গেল। এই গল্পটি বনবাসী সমাজে প্রচলিত অনেকানেক গল্পের মতোই, যা প্রমাণ করে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী বনবাসী কৌমসমাজেরও উত্তরাধিকার।