গল্প: লকডাউন -পিয়ালী মুখার্জী

0
767

পিয়ালী মুখার্জী

নীলা কথা বলা শেষে মোবাইল টা পাশে রেখে উদাস হয়ে জানলার বাইরে তাকালো। মেঘ মুক্ত পরিষ্কার আকাশ, একটা উজ্জ্বল দিন। ঘড়ির ঘন্টা জানান দিলো বিকেল ৪ টে। নীলা চটপট উঠে তৈরি হয়ে নিলো টিউশন যাবার জন্য। বাইরে এখন লকডাউন চলছে কোরোনা ভাইরাসের কারণে। কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছে চেনা শহরটা।

যদিও গ্রীষ্ম, তবুও রেশ রয়ে গেছে বসন্তের। নীল আকাশ আর সাথে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভাসছে উঁচু কৃষ্ণচূড়া মাথা তুলে যেনো তার কানে কানে কিছু বলছে। ফাঁকা রাস্তা ঘাট এ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য যেন কেউ নেই। সারি সারি ফাঁকা বাস রাস্তায় পাশে পড়েছে ধুলোর আস্তরণ। দু একজন মানুষ হয়তো বেরিয়েছে খুব প্রয়োজনে।

মোড়ে মোড়ে পুলিশি টহল। সবাই মুখ ঢেকেছে মাস্কে। এমন ফাঁকা রাস্তা এ শহরের বুকে যেন কল্পনার অতীত। বড় রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলা যেন এক অনন্য অভিজ্ঞতা।রাস্তার বড় বড় বিজ্ঞাপন গুলো এখন সুধুই দৃশ্যদূষণ। সব কিছু মিলিয়ে নীলার যেন ভালোলাগা, উদ্বেগ, চিন্তার অনুভূতি গুলো দানা বাঁধলো।

বেশ লাগছে হওয়া টা ঝিরি ঝিরি। দরজায় বেল দেবার পর একটু অপেক্ষা। এই বাড়ির দুই মেয়েকে পড়ায় নীলা। মেয়ে দুটি খুব পছন্দ করে নীলা কে। ওদের মা রুপালি কে নীলা কাকিমা বলে। দরজা খুলতেই নীলা ভেতরে ঢুকতে উদ্দত হলো। রুপালি কাকিমা কেমন যেন বাধা দিলেন, বললেন “নীলা, আজ থেকে আর ওদের তোমাকে পড়াতে হবে না।” নীলা নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারলো না।

আবারও জিজ্ঞাসা করলো… মাথাটা কেমন ঝিম কেমন ঝিম করে উঠলো, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না যেন। বললো “কেন কাকিমা, আমার কি কোনো ভুল হয়েছে?” রুপালি কাকিমা আমতা আমতা করে বললেন “তোমার কাকুর চাকরি টা বোধ হয় আর থাকবে না, বেতন পায়নি এ মাসে, আমাদেরই কেমন করে চলবে জানিনা, তাই…”

“কিন্তু কাকিমা মেয়ে দুটোর পড়াশোনা কেমন করে হবে! এই মাঝখানে বন্ধ করে দিলে ওদের হয়তো খুব অসুবিধা হবে”
“কি করবো নীলা, বাড়িতে অসুস্থ শাশুড়ি আছেন, দুই মেয়ে আমি তোমার কাকু… আমাদের নিজেদের সংসার চলাটাই তো দায়, তার ওপর এই বাড়তি খরচ চালাতে পারবো না গো”

“কিন্তু কাকিমা আমি যে এই পয়সা দিয়ে মায়ের ওষুধ কিনি, বাবার ইনহেলার লাগে, বোনটা এখনো পড়াশুনা করছে… আপনি তো জানেন আমার এই টিউশন এর পয়সায় প্রায় গোটা সংসার টা চলে, আমি এখন এই অবস্থায় কোথা থেকে টিউশন জোগাড় করবো?”

চোখের সামনে উজ্জ্বল বিকেল টা কেমন ধূসর হয়ে গেলো নীলার। দরজা টা মুখের ওপর বন্ধ হয়ে গেলো। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো নীলা। এই ভাবে যদি ওর সব টিউশন বন্ধ হয়ে যায় তাহলে স্বপরিবারে মৃত্যু ছাড়া গতি নেই।

ত্রাণের লাইনেও তো দাঁড়াতে পারবে না আত্মসম্মানে লাগবে। সারি সারি বন্ধ দোকানের ঝাঁপ, তাহলে কি সবার অবস্থা এমনই! ভাবে নীলা। যারা ওই দোকান গুলো তে কাজ করে, যারা ফুটপাতে হকারী করে, রাস্তার পাশে রোল চাওমিনের ছোট্ট দোকান, বাসের চালক – কন্ডাক্টর, অটো চালকরা, এই রকমই হাজার হাজার জানা অজানা কম রোজকারের পেশার সাথে যারা যুক্ত তারা কি করছেন এই অতিমারীর সংকটে?

শুধু মাঝে মাঝে কয়েকটা ওষুধের দোকান খোলা, তাই দেখে নিলাম আবারও বাবা, মার এই মাসে ওষুধ কেমন করে কিনবে ভেবেই পায় না। চা ওয়ালা দাদার সাথে দেখা, যায় রাস্তার ধারে ছোট্ট টি স্টল। দোকান বন্ধ তাই অগত্যা সংসার চালাতে চাইকেলে চেপে চা বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন।

ফেরার সময় নীলা দেখলো ঈশান কোন মেঘ জমেছে, খুব দ্রুত সারা আকাশ চেয়ে গেল। কৃষ্ণচূড়া ফুল গুলো মাটিতে ঝরে পড়ছে। একটা প্রচন্ড কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। তাড়াতাড়ি পা চালায় নীলা। মা দেখে বলে “কিরে চলে এলি বাড়ি…?”
“হ্যাঁ মা, ওরা আজ কোথায় যেন যাবে তাই আজ পড়লো না”
“এই লকডাউনে আবার কোথায় যাবে….”
নীলা কোনো উত্তর না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়। বাইরে তুমুল ঝড়ের সাথে মুসলধারায় বৃষ্টি। নীলা আকুল হয়ে কাঁদে, দূরের ওই গাছ টা যেমন ঝরে বৃষ্টিতে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ঠিক নীলার ভেতরটার মতোই। সাধারণ মানুষ গুলো বোধ হয় এই ভাবেই সারা জীবন খইতে থাকে জীবন সংগ্রামে। (গল্পের – ছবি, পিয়ালী মুখার্জী)৷

Previous articleWeather Updates: বঙ্গে বর্ষার দুরন্ত ব্যাটিং -এর জের: ভারী বৃষ্টি চলবে শনিবার পর্যন্ত, আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস
Next articleদেশের রান্নাঘর: বাদাম ভর্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here