দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ ভ্যাকসন প্রয়োগের দিন ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। মকর সংক্রান্তির পর ১৬ জানুয়ারি থেকে হবে দেশ জুড়ে টিকাকরণ। তার আগে সোমবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ভিডি কনফারেন্সে সরাসরি প্রশ্নটা করেই ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সূত্রের মতে, বৈঠকে এদিন মমতা প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা ভ্যাকসিনের সাইড এফেক্ট তথা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই তো!’ জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, জনগণকে আতঙ্কমুক্ত করতে সরকার এই বিষয়টি স্পষ্ট করে বলুক।
ভারতে তৈরি ভারত বায়োটেকের টিকা কোভ্যাক্সিনের তৃতীয় তথা শেষ দফার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া শেষের আগেই টিকা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহল থেকে। সেই দিকে ইঙ্গিত করে মমতা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘অনুমোদন দেওয়া দু’টি টিকার কার্যকারিতা নিয়ে কোনও তথ্য কি রাজ্য সরকারকে দেওয়া হবে?’’ ছাড়পত্র দেওয়ার আগে টিকার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মতামত নেওয়া উচিত বলেও মত প্রকাশ করেন মমতা। তাঁর প্রশ্নের জবাবে নীতি আয়োগের সদস্য বিনোদ কে পাল বলেন, ‘‘দু’টি টিকাই সম্পূর্ণ নিরাপদ। বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত যে, কোনও টিকারই কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই।’’
ওই বৈঠকের পর তৃণমূলের তরফেও একটা ‘নোট’ দেওয়া হয়েছে সংবাদমাধ্যমকে। তাতেও পরিষ্কার লেখা রয়েছে যে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চেয়েছেন, কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিন—এই দুই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে যথাযথ বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে তো!
দেশের সব মুখ্যমন্ত্রী এদিনের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। বৈঠক শেষে উত্তর-পূর্বের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, দুটি ভ্যাকসিনের কোনওটিতেই কোনও সাইড এফেক্ট বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এও বলা হয়েছে, এই ধরনের প্রশ্ন যদি এখন তোলা হয় তাহলেই বরং জনমানসে আতঙ্ক ছড়াতে পারে।
গত রবিবার ৩ জানুয়ারি সকালে প্রথম সুখবর এসেছিল। সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন ও ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিন প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছিল ডিরেক্টর জেনারেল অব ড্রাগ কন্ট্রোল। তারা জানায়, জরুরি ভিত্তিতে দুটি কোভিড ভ্যাকসিনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
দুটি টিকাকে ছাড়পত্র দেওয়ার পরে বিভিন্ন মহল থেকে টিকা কতটা নিরাপদ তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছিল। রবিবার সন্ধ্যায় তার জবাব দিয়ে দেন ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া ভিজি সোমানি। সাংবাদিক বৈঠক করে তিনি জানান, দুটি টিকাই ১১০ শতাংশ নিরাপদ। মানুষের সুরক্ষা নিয়ে ন্যূনতম সংশয় থাকলে অনুমতি দেওয়া হত না।
জানা গিয়েছে, এদিনের বৈঠকে কেবল দু’জন মুখ্যমন্ত্রীকে বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দুই, কেন্দ্রশাসিত পুদুচেরির কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী। ঘটনা হল, দুই মুখ্যমন্ত্রীই বিরোধী দলের। নারায়ণ স্বামী এদিন বলেছেন, কোভিড ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রক্রিয়া কী ভাবে হবে, পরিবহণ ব্যবস্থা কী হবে, এ ব্যাপারে কেন্দ্র গাইডলাইন বেঁধে দিক। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের এক আমলা ভিডিও কনফারেন্সের পর কটাক্ষ করে বলেছেন, তাঁর মানে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল ওই রজায সরকার এখনও পর্যন্ত কোনও প্রস্তুতিই নেয়নি।
তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠকে জানিয়েছেন, ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য রাজ্য সরকার সম্পূর্ণ প্রস্তুত। জেলায় জেলায় ভ্যাকসিন বন্টনের কাজও মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়ে যাবে। তা ছাড়া প্রথম পর্বে যে ৪৪ হাজার সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মীকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে তাঁদের তালিকাও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে।
ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন বাংলার সব মানুষকে রাজ্য সরকার বিনামূল্যে ভ্যাকসিন ‘পৌঁছে’ দেবে। তা নিয়ে বিজেপির তরফে কটাক্ষও করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিচ্ছে। কোনও রাজ্যের কাছে আলাদা করে ভ্যাকসিন এখনই আসবে না। কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এর মধ্যেও ক্রেডিট নিতে চাইছেন। আমি ভাবছি, তিনি এই প্রকল্পকে ‘টিকাশ্রী’ বলে চালিয়ে না দেন।
রবিবারই বাংলার পুলিশ কর্তা ও স্বাস্থ্যকর্তাদের পাঠানো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চিঠি প্রকাশ্যে আসে। সেখানে রাজ্যবাসীকে বিনামূল্যে করোনার টিকা দিতে চাওয়ার কথা জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তা নিয়ে পালটা আক্রমণ শানিয়েছে বিজেপি। রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের কটাক্ষ, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীদেশের ১৩৫ কোটি মানুষকেই বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেবেন বলে আগেই জানিয়েছেন। কিন্তু আরও সব জিনিসের মতো মুখ্যমন্ত্রী এটাও প্রধানমন্ত্রীর থেকে চুরি করছেন। চাল চুরি করেছেন, এখন ভ্যাকসিন চুরি করছেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজে কি টিকা আবিষ্কার করেছেন?’ এছাড়াও শুভেন্দু অধিকারী, অমিত মালব্য, বাবুল সুপ্রিয়র মতো নেতারাও মমতাকে টিকা নিয়ে নিশানা করেছেন। কিন্তু এদিন বৈঠকের পর একবারের জন্যও গোটা দেশে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা বলেননি প্রধানমন্ত্রী মোদী। বরং করোনার ‘ফ্রন্ট লাইন’ যোদ্ধাদের জন্য ব্যবহৃত প্রথম তিন কোটি টিকা কেন্দ্রীয় সরকার দেবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘যাঁরা আমাদের জীবন বাঁচাচ্ছেন, দেশের সেই ৩ কোটি স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য যে টিকা লাগবে, তার খরচ রাজ্য সরকারকে দিতে হবে না। তা কেন্দ্রীয় সরকার দেবে।’ এরপরই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, বিজেপি নেতারা যেখানে গোটা দেশে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেবেন মোদী, এমন প্রচার করছেন, সেখানে মোদীর ইঙ্গিত একেবারেই তা নয়। বরং তিন কোটি ডোজের পর খরচ রাজ্যের উপর বর্তাতে পারে বলেই ইঙ্গিত রয়েছে তাঁর মন্তব্যে।
এদিন প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরবর্তী পর্যায়ে ভারত। আমরা ভ্যাকসিন নিয়েও যে কর্মসূচি গ্রহণ করছি, তা বিশ্বের বহু দেশ অনুসরণ করবে। যে ২টি ভ্যাকসিনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, দু’টিই মেড ইন ইন্ডিয়া। আরও ভ্যাকসিন এলে ভবিষ্যতে আরও পরিকল্পনা করা যাবে। ভারতীয় ২টি ভ্যাকসিন বিশ্বের অন্য সমস্ত টিকার চেয়ে সস্তা।’
একইসঙ্গে রাজ্যগুলিকে তাঁর পরামর্শ, ‘প্রতিটি রাজ্য সরকারকে ভ্যাকসিনের গুজবে যাতে না ছড়ায়, তার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেকেই ভারতের এই বিরাট অভিযানে বাধা তৈরির চেষ্টা করতে পারে। আরও অন্যান্য ভ্যাকসিনের কাজও চলবে। করোনার মধ্যেই দেশের ৯ রাজ্যে বার্ড ফ্লুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। তার জন্য প্রতিটি জেলা প্রশাসনকে পদক্ষেপ নিতে হবে। বার্ড ফ্লু নিয়েও যেন কোথাও গুজব না ছড়ায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।’