এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত:

0
3375

ড. প্রদীপ্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

বৈচিত্রে ভরপুর ভারতের জাতীয়তাবাদের একটি অনন্য সুর রয়েছে। সাতনরি হারের মতোই বিস্ময়কর নানা রঙের অনবদ্য সমাহার। গান্ধীজীর কথা দিয়েই শুরু করা যাক। গান্ধীজী লিখেছিলেন, ভারতের  জাতীয়তার ভাবধারায় “আমি” ও ”আমার”এই সংকীর্ণ চিন্তা বিসর্জন দেওয়াই সর্বতোভাবে কাম্য।

অহিংসা জাতীয়তাবাদী সভ্য জীবনের অন্যতম প্রয়োজনীয় শর্ত। শুধু পরিবারের কয়েকজন বা গোষ্ঠীর লোকজন নয়, সমগ্র জাতির স্বার্থ দেখাই প্রকৃত জাতীয়তাবাদের লক্ষণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ খাঁটি জাতীয়তাবাদী ছিলেন বলেই আন্তর্জাতিক মূল্যবোধে অটল ছিলেন। 
গান্ধীজী মূলত বিভেদ দূর করে এক সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের পরিবেশ প্রস্তুত করতে সারা জীবন ব্যয় করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ঐক্য ছাড়া স্বরাজ অসম্পূর্ণ ও অর্থহীন।  


ভারতের আবহমানকালের সুপ্রাচীন ইতিহাস বহুমুখী, সিন্ধু সভ্যতা থেকে ধরলে প্রায় ৫০০০ বছরের ধারাবাহিক ঐতিহ্য। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের দেশ এই ভারত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা দুর্বার স্রোতে এলো কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা।”বহমান ইতিহাসের ধারায় নৃতাত্ত্বিক, আর্থ-সামাজিক, ভাষাতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন এসেছে। নতুন চেতনা ও ভাবধারার মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের কাহিনী রয়েছে এবং প্রগতির নানা ধারার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ কালখন্ডে জাতি, পরিবেশ ও মুহুর্তের বিশ্লেষণে মানব জীবনের ওঠা-পড়ার কথা উঠে এসেছে।  
বৈচিত্রের কারণে ভারতের জাতীয়তাবাদী ভাবধারা গঠনে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই নানা শক্তি কখনও পরিপূরক, কখনও বা পরস্পর বিরোধী শক্তির সংস্পর্শে নানা রূপ নিয়েছে। এই সব শক্তির বিরোধে গ্রহণ – বর্জনের মাধ্যমে মিলে মিশে এক সমন্বয়ের ভাবনায় জারিত হয়ে নতুন রূপ নিয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনে উপনিবেশবাদ বিরোধী ভাবধারায় যে জাতীয়তার ধ্যান – ধারণা গড়ে উঠেছিল, তার উপর ভিত্তি করে যে গণতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হল, সেখানে  নতুন ভাবে উদ্বুদ্ধ হল জাতি,  জাতীয়তাবাদও আরো এক নতুন মাত্রা পেল।

ছোট ছোট এলাকার প্রান্তিক মানুষজন বিভিন্ন রক্ষা কবচের মাধ্যমে কখনও ষষ্ঠ তপশীল বা অন্যান্য ধারায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সমর্থ হল। ক্ষুদ্র পরিচিতি ও অস্তিত্ব, বৃহৎ পরিচিতির সঙ্গে সরাসরি ও পারস্পরিক সম্পর্কের সাহায্যে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদে নতুন মাত্রার সংযোজন করল। জাতির চলার পথে এতে কখনও কখনও যে টানাপোড়েন ও সংঘর্ষের বাতাবরণ তৈরি হয় নি এমন নয়। তবু শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে এক নতুন সংস্কৃতি ও জীবন শৈলীর নির্মাণ সম্ভব হয়েছে।  প্রান্তিক নানা এলাকা, রাজ্য ও বিশেষ করে উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে ভারতের নতুন জীবন ধারার অভূতপূর্ব সমন্বয়ে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে  সর্বভারতীয় পরিচিতির উদ্ভব সম্ভব হয়েছে। আর এভাবেই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে “সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে এক সজীব নবজীবন রচনা করেছে।” 


ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তাই সমষ্টি ভাবনার সমাহার। ভাষা, ধর্ম, সামাজিক ঐতিহ্য ও ইতিহাস সব দিক থেকে অভূতপূর্ব ও বৈচিত্রে গড়া।

    
এই জাতীয় সংহতি যে কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাত্ত্বিকেরা বলেন, এই সংস্কৃতি দু’ভাবে হতে পারে। একটি হল, অঞ্চল ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, যা ছোট ছোট সংস্কৃতি ও পরিচিতিকে ছাপিয়ে বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রভাব বিস্তার করবে, এটিকে আমরা জাতীয় আত্তীকরণ প্রক্রিয়া বলতে পারি।  অপরটি হল, ছোট ছোট সংস্কৃতিকে বজায় রেখে জাতীয় আনুগত্যকে দৃঢ় করা, যাতে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ভাবনা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই ভারতীয় জাতীয় সংহতির মূল কথা।

১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে জাতীয় সংহতি পরিষদ গঠিত হয়। এর নানা দিক – রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও ভাবগত – রয়েছে। ঐক্যবদ্ধ ভারত বা জাতীয় সংহতির মূল বৈশিষ্টগুলি হল – ভূমিগত ঐক্য এবং সমগ্র অঞ্চলে জাতীয় ও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, সামাজিক ক্ষেত্রে সমগ্র জনগোষ্ঠী যেন ন্যায় ও সাম্যের বাতাবরণে বাস করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা, যেন তারা নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচিতি বজায় রাখতে পারে ও মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে, তা সুনিশ্চিত করা।  


এই পটভূমিতে “এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত” অভিযান শুরু হয়। ২০১৫ খ্রীস্টাব্দে ৩১শে অক্টোবর ভারতের প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই ঘোষণা করেন। বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চলের জনগণের মধ্যে যাতে বোঝাপড়া ও একে অপরকে জানা সম্ভব হয়, তার ব্যাপক ও সুচারু ব্যবস্থা করাই এই অভিযানের উদ্দেশ্য। 


এর মাধ্যমে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণা প্রচার করা এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসিক ও ভাবগত বন্ধন সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।  এখানে এমন একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে যাতে রাজ্যগুলি ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জনগণের মধ্যে জাতীয় সংহতির ধারণার ব্যাপক প্রচার চলে। 
রাজ্যগুলির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে যাতে একে অপরের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত হতে পারে, তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।  এর পাশাপাশি বোঝাপড়ার জন্য দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চলগুলির জনগণ যাতে একে অপরের সঙ্গে অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারে ও কাজের ধারার বিষয়ে আদান-প্রদান করতে পারে তার জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলাও এর উদ্দেশ্য।  


মূল কথা হল বিভিন্ন রাজ্য়ের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ ও বন্ধনের আবহ গড়ে তুলতে  বিভিন্ন ভৌগলিক অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ আচার – অনুষ্ঠান, খাওয়া – দাওয়া, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, সিনেমা, হস্তশিল্প, পোষাক – পরিচ্ছদ, খেলাধূলা, উৎসব, অনুষ্ঠান, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও নানা জীবনধারাকে  অন্য অঞ্চলের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে  ধারাবাহিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে । এক অঞ্চলের সংস্কৃতি ও অর্থনীতি যে একে অপরের পরিপূরক হতে পারে,  এই আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্কের সাহায্যে সে বিষয়ে অবহিত হলে অসহিষ্ণুভাব দূর হয়। আন্তঃরাজ্য ভ্রমণের ফলে একটি শিক্ষা ও পরিচিতির আবহ গড়ে ওঠে, যা জনমানসে ও বিভিন্ন অংশীদারের মধ্যে উন্নত পরিবেশ গঠনে সহায়ক হয়।  
এব্যাপারে দেশের বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি বাস্তব সম্মত আদান – প্রদানের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

একের সঙ্গে অপরকে জুড়ে দেওয়ার এই কর্মসূচীতে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে ১৬টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন – কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর, তামিলনাডুর সঙ্গে, পঞ্জাব অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে, উত্তরাখন্ড কর্ণাটকের সঙ্গে জোড়া হয়েছে। 
ভ্রমণ ছাড়াও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের কার্যক্রমের মধ্যে কবি, সাহিত্যিকদের বিভিন্ন রাজ্যে ভ্রমণ, খাদ্য উৎসব, সিনেমা উৎসব, ফটো প্রদর্শনী, ছাত্রদের শিক্ষামূলক ভ্রমণ, রচনা প্রতিযোগিতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। 


পরিশেষে , ভারতের ঐক্য স্থাপনের এই কর্মযজ্ঞে সর্দার প্যাটেলের মূল্যবান অবদানের কথা স্মরণ করেই ট্যাচু অফ ইউনিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা উচ্চতায় সর্ববৃহৎ। প্রধানমন্ত্রী মোদী, তাঁর “মন-কি-বাত” অনুষ্ঠানে বলেছেন – সর্দার প্যাটেল, তাঁর সমগ্র জীবন ভারতের ঐক্যের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। সর্দার,  কৃষকের বিষয়কে স্বাধীনতার সঙ্গে মিলিয়েছিলেন, দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে একীকরণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় ঐক্যের মূর্ত প্রতীক।  


এরকম এক মহান ব্যক্তিত্বের জন্মদিন উপলক্ষ্যে “এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত” অভিযানের গুরুত্ব অপরিসীম, সুগভীর অর্থবহ। দেশ গঠন ও বিকাশের উপযোগী। এই একতার মধ্যেই রয়েছে শক্তি, উন্নয়ন ও সশক্তিকরণের মন্ত্র। 
নিজের ৭৫তম জন্মদিনে এক বক্তৃতায় প্যাটেল দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন – ভারতকে শক্তিশালী করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। খুব কম দেশই আছে, যা আয়তনে বিশাল ও সম্পদে ভরা, তাই ভারতের উন্নয়নে আমাদের নিরন্তর কাজ করা প্রয়োজন। শ্রেষ্ঠ ভারত গঠনে সর্দার প্যাটেলের এই আহ্বান, আজ খুবই প্রাসঙ্গিক।

লিখেছেন : বিশিষ্ট লেখক ড. প্রদীপ্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ( মতামত ব্যক্তিগত)

Previous articleভিক্ষার টাকা জমিয়ে ফলের দোকান খুললেন পোলিও আক্রান্ত রমা
Next articleলক্ষ্মীপুজোর দিন সোনা-রুপোর দর কী? জানুন:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here