দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ মণীশ শুক্ল খুনে অন্যতম অভিযুক্ত নাজির খানকে বুধবার ভোররাতে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। গতকাল রাতেই তাকে আটক করা হয়েছিল। নাজিরকে জিজ্ঞাসাবাদও শুরু করেছিলেন সিআইডি-র তদন্তকারীরা। তখনই আভাস পাওয়া গিয়েছিল যে জেরার শেষে সম্ভবত নাজিরকে গ্রেফতার করা হবে। সেটাই হয়েছে। সিআইডি সূত্রে খবর, ব্যারাকপুরের বিজেপি নেতাকে খুন করার আগে এলাকায় রেইকি করেছিল এই নাজির। এছাড়াও যারা গুলি চালিয়েছিল সেই শ্যুটারদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল তার। তবে নাজির নিজে গুলি চালিয়েছিল কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। জানা গিয়েছে, আজ নাজিরকে আদালতে পেশ করা হবে।
পুলিশ সূত্রে জানাগিয়েছে তিন দিন ধরে ছায়ার মতো সেঁটে ছিল তিন ভাড়াটে ইনফর্মার। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপের খবর চুপিসারে চলে যাচ্ছিল আততায়ীদের কাছে। বিন্দুবিসর্গ টের পাননি মণীশ শুক্লা। রবিবার বাড়ি থেকে বেরনো ইস্তক মণীশের গতিবিধি প্রায় প্রতি মিনিটে ফোনে আততায়ীদের রিলে করেছে ইনফর্মার ত্রয়ী। ফলে, সন্ধেয় যে তিনি সাংসদ অর্জুন সিংয়ের গাড়ি থেকে নেমে একাই টিটাগড়ে চায়ের দোকানে যাচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে যে দেহরক্ষীরা নেই- সে সব খবর সময়মতো পৌঁছে গিয়েছিল ভাড়াটে খুনিদের কাছে। অতঃপর মওকা বুঝে অপারেশন। দু’টি বাইকে চেপে জনা পাঁচেক এসে পরপর গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় মণীশের দেহ। এই খুনে ব্যারাকপুর এবং টিটাগড়ের পুর-প্রশাসকদের নামে অভিযোগ এনেছেন মণীশের বাবা। যদিও দুই পুর-প্রশাসকের বক্তব্য, অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন।
সোমবারই তদন্তকারীরা জালে তোলেন খুররম খান এবং গুলাব শেখ নামে দু’জনকে। রাতভর জেরার পরে মঙ্গলবার সকালে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। জেরায় উঠে এসেছে প্রতিশোধের তত্ত্ব। এক দশক ধরে মণীশকে নিকেশ করার ছক কষে চলেছে খুররম। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়ে মরিয়া ছিল সে। ২০১০ সালে খুন হন খুররমের বাবা, বস্ত্র ব্যবসায়ী এমআই ইসলাম। খুররমের অভিযোগ, মণীশই লোক লাগিয়ে তার বাবাকে খুন করান। এর আগে তাই দু’বার, ২০১১ এবং ২০১৩ সালে মণীশকে খতম করার চেষ্টা চালিয়েছিল সে। কিন্তু অল্পের জন্য ফস্কে গিয়েছিল ‘শিকার’। এর পর সাত বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা। অবশেষে আটঘাট বেঁধে ফের খুররম তৈরি হয়। সিআইডি-র বক্তব্য, গোটা অপারেশনে জনা সাতেক যুক্ত। যদিও খুররম এবং গুলাব জেরায় দাবি করেছে, গুলি তারা চালায়নি। তাদের জেরা করে বাকিদের খোঁজ চালাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
আরও একটি দিক খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। মণীশের পরিবারের তরফে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, তাতে কয়েকজন তৃণমূল নেতার নামও রয়েছে। অভিযোগ, ওই নেতারাই মণীশ-হত্যার মাস্টারমাইন্ড। দুষ্কৃতীদের ভাড়া করেছিলেন তাঁরাই। ফলে, এই খুন নেহাতই খুররমের পরিকল্পনা না এর পিছনে অন্য কারও মাথা রয়েছে, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। বিশেষ করে প্রশ্ন থাকছে- দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হওয়ার দীর্ঘ সাত বছর পরে হঠাৎ কেন খুররম মরিয়া হয়ে উঠল? তার পুরোনো ঘা উস্কে দিয়ে আড়াল থেকে কেউ মণীশকে সরিয়ে দেওয়ার ছক কষেনি তো?
তবে খুন যে রীতিমতো পরিকল্পনা করেই হয়েছে, সে বিষয়ে তদন্তকারীরা একপ্রকার নিশ্চিত। সিআইডি সূত্রের খবর, মাসখানেক আগে থেকে শুরু হয় পরিকল্পনা। এক ভাড়াটে খুনি ও তার দলবলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। রফা হয় মোটা অঙ্কের টাকায়। তদন্তকারীদের বক্তব্য, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে যাচ্ছিল খুনিরা। কিন্তু মোক্ষম সুযোগটি কিছুতেই পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত তিনজন ইনফর্মারকে কাজে লাগানো হয়, যারা আলাদা আলাদা ভাবে মণীশকে ফলো করতে থাকে। প্রতি মুহূর্তের খবর চলে যেতে থাকে খুনিদের কাছে।
রবিবার রাত সওয়া আটটা নাগাদ মণীশ গাড়ি থেকে নেমে চায়ের দোকানে পৌঁছন। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’টি বাইকে চেপে সেখানে হাজির হয় জনাপাঁচের দুষ্কৃতী। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, খুব কাছ থেকে গুলি করা হয় মণীশকে। যেটুকু ধরা পড়েছে, তাতে একাধিক খুনি গুলি চালিয়েছিল বলে অনুমান। ঘটনাস্থল থেকে ১৭টি নাইন এমএম পিস্তলের গুলির খোল মিলেছে। ময়না-তদন্তে মণীশের শরীরে অন্তত ৭টি নাইন এমএম গুলি পাওয়া গিয়েছে।
মণীশের বাবা চন্দ্রমণি শুক্লা পুলিশে যে অভিযোগ দায়ের করেছেন, তাতে নাম রয়েছে স্থানীয় দুষ্কৃতী খুররম খান, বাঁটুল, আরমান মণ্ডল, রঞ্জিত পাল-সহ কয়েকজন দুষ্কৃতীর। নিহতের বাবার দাবি, ছেলের উপর ওই দুষ্কৃতীরাই গুলি চালিয়েছে। অভিযোগপত্রে রয়েছে ব্যারাকপুরের পুর-প্রশাসক উত্তম দাস এবং টিটাগড়ের পুর-প্রশাসক প্রশান্ত চৌধুরীর নামও। অভিযোগ, স্থানীয় দুষ্কৃতীদের কাজে লাগিয়েছিলেন এই নেতারাই। অভিযোগের ভিত্তিতে উত্তম দাস, প্রশান্ত চৌধুরী, রঞ্জিত যাদব, বাঁটুল, খুররম খান, নাজির খান, আরমান মণ্ডল এবং বিপিটি ভোলা প্রসাদের নামে খুন এবং অস্ত্র আইনে মামলা রুজু করেছে পুলিশ। যদিও দুই পুর-প্রশাসকের দাবি অভিযোগ যে কেউ করতে পারেন। কিন্তু তাঁর তো একটা ভিত্তি থাকতে হবে! আইনি পথেই তাঁরা লড়াই করবেন। ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং বলেন, ‘তৃণমূল এবং পুলিশের যোগসাজসেই মণীশ শুক্লাকে হত্যা করা হয়েছে। ধৃতদের থেকে উদ্ধার হওয়া ৯এমএম পিস্তল পুলিশের কাছেই থাকে।’ তাঁর দাবি, ধৃতদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠতার প্রমাণও তাঁদের হাতে আছে। জানান, মণীশের হত্যায় সিবিআই তদন্তের দাবিতে তাঁরা আদালতের দ্বারস্থ হবেন।