দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ একুশ সালে বাংলায় সঠিক সময়ে ভোট হলে মেরেকেটে আর ন’মাস হাতে রয়েছে। লকডাউনের মধ্যেই বাংলায় প্রচারের মহড়া শুরু করে দিল গেরুয়া শিবির। বিজেপি ক্ষমতায় এলে বিকল্প মডেল কী হবে মঙ্গলবার ভার্চুয়াল জনসভা থেকে তা যেমন তুলে ধরলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, তেমনই দুর্নীতি ইস্যুতেও তৃণমূকে বিঁধলেন প্রাক্তন বিজেপি সভাপতি।
করোনা পরিস্থিতিও ইস্যু হবে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে। সরাসরি করোনা পরিস্থিতি না হলেও এই সময়ে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে তৈরি হওয়া রাজনীতি যে দীর্ঘস্থায়ী হবে সেটা নিশ্চিত করে দিলেন অমিত শাহ। একুশের ভোটের লক্ষ্যে রাজ্যের প্রথম ভার্চুয়াল জনসভায় অমিত শাহ সরাসরি বলেই দিলেন, ‘করোনা এক্সপ্রেস’ চেপেই বাংলা থেকে বিদায় নেবে তৃণমূল কংগ্রেস। একই সঙ্গে তিনি বলেন, “সিএএ বিরোধিতা তৃণমূল কংগ্রেসকেই উদ্বাস্তু বানিয়ে দেবে।”
সেই যেদিন থেকে পরিযায়ী শ্রমিদের বাংলায় ফেরানোর প্রশ্ন উঠেছে সেই দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় রাজনীতি। কখনও রাজ্য সরকারের অনীহা নিয়ে প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী সরব হয়েছেন কখনও প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এনিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ফোনও করেছিলেন অমিত শাহ। কিন্তু এবার বিজেপির নেতা হিসেবে সেই ইস্যুতে আক্রামণ শানালেন প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি।
ভিন রাজ্যে কাজ করা বাংলার শ্রমিকদের ফেরাতে রাজ্য সরকার কতটা অনীহা দেখিয়েছে তা তুলে ধরতে এদিন হিসেবও দিলেন অমিত শাহ। বললেন, বাংলায় পরিযায়ী শ্রমিক আনতে মাত্র ২৩৭টা শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন এসেছে। যেখানে উত্তরপ্রদেশে ১৭০০ এবং বিহারে ১৫০০ ট্রেনে গেছে। এই রাজ্যে ট্রেনে করে আনা হয়েছে তিন লাখ শ্রমিককে। আর তার পরেই টেনে আনলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘করোনা এক্সপ্রেস’ মন্তব্যের প্রসঙ্গ।
পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরাতে শুরু করার পরে রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বোঝাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনকে ‘করোনা এক্সপ্রেস’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এর পরেই সেটা ইস্যু করে ফেলে রাজ্য বিজেপি। এতে শ্রমিকদের অপমান করা হয়েছে বলে দাবি করেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ। এবার সেই একই সুর শোনা গেল অমিত শাহর গলাতেও। তিনি এদিন বলেন, রাজ্য সরকারের বাধায় এই রাজ্যে সবথেকে কম শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চলেছে।
আর ‘করোনা এক্সপ্রেস’ বলে যে শ্রমিকদের অপমান করা হয়েছে সেই ট্রেনে করেই বাংলার মানুষ তৃণমূলকে বাইরে পাঠিয়ে দেবে। অমিত শাহর কথায়, “পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে শ্রমিক স্পেশাল চালাচ্ছে কেন্দ্র। কিন্তু অবাক করা বিষয় যে ওই ট্রেনকে ‘করোনা স্পেশাল’ বলে কটাক্ষ করেছেন মমতা দিদি। ওই ট্রেনই তৃণমূল সরকারকে এক্সিট রুট দেখাবে।”
অমিত শাহর অভিযোগ, করোনা, উমফানের মতো চরম সংকটের সময়ও এই রাজ্যে দুর্নীতি হচ্ছে। এই সময়ও তৃণমূলের নেতৃত্বে রাজ্যে একের পর এক হিংসার ঘটনা ঘটছে। কেন্দ্রের টাকায় চলছে তোলাবাজি। ত্রাণের টাকা চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেট ভেট হিসেবে। এদিন নাগরিকত্ব আইন থেকে পরিযায়ী শ্রমিক ইস্যু, সব প্রসঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসকে নিশানা করেন অমিত শাহ। তিনি বলেন, “মমতা দিদি, মতুয়া, নমঃশূদ্র ও বাংলাদেশ থেকে যাঁরা এদেশে শরণার্থী হয়ে এসেছেন তাঁদের নাগরিকত্ব পাওয়াকে কেন বিরোধিতা করছেন? তোষণের রাজনীতির জন্য সিএএ-এর প্রতিবাদ করা হচ্ছে। উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের সুবিধা মোদী সরকার দেবেই। ভোটে মমতা সরকারকেই উদ্বাস্তু করে দেবে বাংলার মানুষ।”
এদিনের ই-জনসভায় অমিত শাহ বলেন, “গর্বের সোনার বাংলায় এখন শুধুই ভ্রষ্টাচার। একদিকে নতুন কিছু করতে হলে ভাতিজা (পড়ুন ভাইপো) ট্যাক্স দিতে হয় অন্যদিকে সিন্ডিকেট রাজের রমরমা। চারিদিকে শুধু তোলাবাজি। স্কুল-কলেজে ভর্তি হতে গেলেও টাকা দিতে হয়।”
সেইসঙ্গে সারদা, নারদ কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গও তোলেন কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “দুর্নীতি করতে করতে এমন জায়গায় চলে গিয়েছে মমতাদিদির দল যে, লকডাউনের মধ্যে গরিব মানুষের রেশন নিয়েও দুর্নীতি করেছে।” ভুলে গেলে চলবে না লকডাউনের মধ্যে রেশন দুর্নীতি নিয়ে শুধু বিরোধীরা নয়, স্বয়ং রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় পর্যন্ত সরব হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে টুইট করে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান বলেছিলেন, “গণবন্টন ব্যবস্থায় যে দুর্নীতি হচ্ছে তা যদি এক্ষুণি বন্ধ না করা যায় তাহলে অতীতের সমস্ত দুর্নীতিকে ছাপিয়ে যাবে।” তারপর দেখা গিয়েছিল খাদ্যসচিব বদল করে নবান্ন। রেশন ডিলারদের শোকজ করার পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়।
এদিন অমিত শাহ দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের পাঁচ বছর এবং প্রথম মোদী সরকারের পাঁচ বছরের তুলনা করে বোঝাতে চান, তাঁদের সরকার বাংলাকে কত অনুদান দিয়েছে। হিসেব দিয়ে তিনি বলেন, দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় বাংলাকে সমস্ত খাত মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক লক্ষ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪-১৯ পর্যন্ত বাংলাকে দেওয়া হয়েছে ৪ লক্ষ ১৯ হাজার কোটি টাকা। তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোপ দেগে শাহ বলেন, “এই টাকা কোথায় গেল তার হিসেব নেই।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে এদিনও তোষণের রাজনীতির অভিযোগ তোলেন অমিত শাহ। তিনি বলেন, “যে বাংলা সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রশ্নে যুগ যুগ ধরে সারা দেশকে দিশা দেখিয়েছে, সেখানে এখন তোষণের রাজনীতি চলছে। ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে গিয়ে বাংলার গর্ব ধুলোয় মিশেছে।”
রাজনৈতিক হিংসা নিয়েও তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণের সুর চড়ান শাহ। বলেন, “আগে যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর শোনা যেত, এখন সেখানে বোমা-গুলির শব্দ শোনা যায়।”
যার জবাব দিতে গিয়ে তৃণমূল এদিন বলেছে, যিনি বাংলার সমাবেশী রাজনীতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন, তিনিই আবার সংস্কৃতির কথা বলছেন। ভুলে গেলে চলবে না বিদ্যাসাগরের মূর্তি সংস্কার করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে মূর্তি অমিত শাহর চোখের সামনেই তাঁর লোকেরা ভেঙেছিল। বাংলার শাসকদলের বক্তব্য, “অমিত শাহ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ওঁর জানা উচিত ন্যশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ রাজ্যগুলিতে বিজেপির সরকার রয়েছে। সেই তুলনায় বাংলা অনেক শান্ত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারে এসেই জঙ্গলমহলকে ঠান্ডা করে দিয়েছেন। পাহাড়ও হাসছে।”