জয়দীপ রায় ,বনগাঁ: বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি। আমাদের প্রতিষ্ঠানের সব শো রুমে ধূপধুনো পুজোর গন্ধ। ব্যবসার সঙ্গে তখন সরাসরি যুক্ত না হলেও কলেজে পড়ার সময় থেকে আমি বাধ্য ছেলের মতো অক্ষয় তৃতীয়ার দিন শো রুমে হাজির।
এই উৎসব আমাদের মতো পরিবারভিত্তিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছে দুর্গাপুজোর চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। বাবা-কাকাদের কাছেই শোনা, বৈদিক বিশ্বাসানুসারে এই পবিত্র তিথিতে কোনও শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। সেই বিশ্বাসে আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রথম হালখাতা খোলা হত, সারা বছরের কল্যাণের আশায়।
এই উৎসব বাড়ি নয়, শো রুম ঘিরেই চলত। বাবা ফণীন্দ্র নাথ রায় ৮৩ বছরে এখনও কর্মরত -তাঁর বন্ধুরা এক সঙ্গে বিভিন্ন শোরুমে ঘুরতেন।প্রচুর অতিথি আসতেন সে দিন। তাঁদের তো ডিসকাউন্ট দেওয়া হতই, তা ছাড়া আমাদের পুরনো কাস্টমারদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হত। দেখতে গেলে বেশ জমজমাট ব্যাপার। সে দিন আমাদের দোকানের কর্মীদের জন্য থাকত স্পেশাল লাঞ্চ। আর অনেক রাত অবধি শো রুম খোলা থাকত বলে দেখেছি।
এই দিনে আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রথম হালখাতা খোলা হত, সারা বছরের কল্যাণের আশায়
পুজোপার্বণে বরাবর আমাদের বাড়িতে নিরামিষ রান্নার চল। তাই ওই দিন শুধু রকমারি মিষ্টিই আমাদেরকে আনন্দ দিতে পারত। সে সময়ে খুব মিষ্টি খেতে ভালবাসতাম।অক্ষয় তৃতীয়া মানেই আমার কাছে মিষ্টি খাওয়া। সে দিন বাড়িতে নিরামিষ হলেও তার পরের রবিবার আমাদের জমায়েত হত বাড়িতে। সাত-আট রকমের বাঙালি পদ, মিষ্টি সহযোগে আমরা যৌথ পরিবারের অক্ষয় তৃতীয়া যেন মহাষ্টমীর রূপ নিত।
রাহুল গাজী, সঞ্জু ঘোষ, আকাশ মুখার্জীকিন্তু এ বার? বনগাঁর সব শোরুম বন্ধ। আজ সকালে সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারলাম একটু ছাড় পাওয়া যাচ্ছে,আহা! মনটা একটু খুশিতে ভরে উঠল সকালে অক্ষয় তৃতীয়ার পুজোটা কোন রকমে নিয়ম মেনে করা হল। পুরোহিত দূরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন,আমার সাথে আমাদের শোরুমের কর্ম রত রাহুল গাজী, সঞ্জু ঘোষ, আকাশ মুখার্জীরা সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিল,পালন করলাম শুভ অক্ষয় তৃতীয়া৷
দেশ স্বাধীনের পরেই আমাদের প্রথম শোরুম তৈরি হয়। তারপরেও তো দেশে মহামারি এসেছে, বিপর্যয়, প্রলয়…কই, অক্ষয় তৃতীয়ার পুজো তো কোনওদিন বন্ধ হয়নি! এ বার বড্ড মন খারাপ করছিল। ওই জোর করে মুখ বন্ধ করে দেওয়া শোরুমগুলো, যা এক সময় আমাদের সকলের কাছে বাড়ির চেয়েও প্রিয় ছিল। কত ঝলমলে সময় কাটিয়েছি আমরা! অথচ আজ চাইলেও সেখানে এক সঙ্গে সব্বাই থাকতে পারছি না, দেখতে পারছিনা কত চেনা অচেনা প্রিয় মানুষদেরকে৷ এবারে কেমন অক্ষয় তৃতীয়া এল পৃথিবী জুড়ে শুধুই মৃত্যুর খবর নিয়ে।