‘ট্রাভেলগ’~ লিখছেন-
দেবাশিস রায়চৌধুরী
কৌশানি যখন পৌঁছলাম তখনও বিকেল মরে যায়নি।পার্বত্য অঞ্চলে গোধূলিবেলা বলে কিনা জানা নেই।তবে বাঙালির কণেদেখা আলো বলতে যা বোঝায় তেমনই আলোয় ভরে আছে চারধার।বড় মায়ামাখা এই প্রকৃতি।এতদিনের মধ্যে এই প্রথম অন্ধকার নেমে আসার আগে আমরা হোটেলে ঢুকলাম।ঘরে মালপত্র ঢোকার আগেই হোটেলের লাউঞ্জে সোফায় বৈকালিক আড্ডায় বসে পড়া হল।পরিবেশও খুব সুন্দর। কাঁচের জানলার ওপাশে গিরিশৃঙ্গদের মহান উপস্থিতি। হোটেলের সামনের রাস্তার ওধারে কৌশানির বিখ্যাত অর্গ্যানিক চা,শাল-সোয়েটারের দোকানের সাইনবোর্ডের আলোগুলো জ্বলে উঠল।শীত মুন্সিয়ারির চাইতে কম হলেও সাত ডিগ্রি তাপ আমাদের কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।এইরকম গল্পঘন পরিবেশ কফি ছাড়া কেমন পানসে মনে হয়।পুঁটে,অলক কিচেনে চলে গেল কফির আয়োজন করতে।মান্তু,পরশ,পিউ,সুব্রত ওরা ব্যস্ত হয়ে একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল মার্কেটের দিকে।এত তাড়াহুড়ো যে অমিয়কে সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলেই গেল।প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেচারি অমিয় লাউঞ্জে এসে ওরা বেরিয়ে গেছে শুনে হতাশ হয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল।ওর হতাশা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। গরম কফি,পকোড়া এসে যায়।আড্ডা আরও উষ্ণ হয়ে ওঠে।মন না চাইলেও আপাতত আড্ডায় ইতি টানতে হয়।অনেকেই চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে নিয়েছে।অগত্যা আমরাও উঠে পড়ি।
এর পরের পর্বটুকু হইহই করে কাটল।সকালে উঠেই দিনটাকে একটু অন্যরকম মনে হয়েছিল, সূর্যোদয়ের অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার যে সৌভাগ্য হয়েছিল তা এখনও আমাকে ছুঁয়ে আছে।দিন কেমন যাবে তা সকাল দেখেই বোঝা যায়,এই প্রবাদ যেন সত্যি হয়ে উঠল।ফেসবুকের সৌজন্যে অনেকেই জেনে গিয়েছিল আমার জন্ম নেওয়া বিশেষ দিনটির কথা।চকৌরি থেকে যাত্রা শুরুর আগে বাসের মধ্যেই পূর্ণ ঘোষণা করে দিয়েছে সে কথা।
বাসে বসেবসে শুভেচ্ছায় প্লাবিত হয়েছি।আসল চমক অপেক্ষা করছিল সান্ধ্য আসরে।পূর্ণ সৈকত পরশ পিউ মান্তু ইতিমধ্যে দোতলার লাউঞ্জ সাজিয়ে নিয়েছে।ওরা জানাল আজ প্রিয়াঙ্কারও জন্মদিন। টেবিলে দুটো বার্থডে কেক মোমবাতি রাখা হয়েছে।টেবিলের চারদিকে চেয়ারে সকলের বসার আয়োজন।প্রথমে প্রিয়াঙ্কা তারপর আমি মোমবাতি নিভিয়ে কেক কাটলাম। সকলে উচ্ছসিত ‘হ্যাপি বার্থডে টু য়্যু’ গাইল।এতক্ষণে বোঝা গেল সুব্রতরা দল বেঁধে কেন বেরিয়েছিল।অচেনা জায়গায় কেক,মিষ্টি, উপহার এইসব ঠিক জোগাড় করে ফেলেছে।আন্তরিকতার কোমল স্পর্শ ছড়িয়ে আছে সন্ধ্যার অসামান্য আয়োজনে।সুষমাদি যখন উপহারে মাফলার উত্তরীয়ের মতো গলায় পরিয়ে দিলেন,তখন সকলের হৃদয়ের উষ্ণতা যেন ছড়িয়ে গেল আমার চেতনার অলিগলিতে। কখনও ভাবিনি জন্মদিন এমন সাড়ম্বরে পালিত হতে পারে,তাও আবার পাহাড়ের উচ্চতায় হিমালয় অঙ্গনে!এরপর গান,কবিতা, নাচ সবকিছু মিলিয়ে জমজমাট অনুষ্ঠান হল।ছোটো বড় সকলের অংশগ্রহণের ফলে আনন্দটা বেশি হল।এই অনুষঙ্গেই হারুদা রাতের খাবারেও ছিল সেলিব্রেশনের ব্যবস্থা।রাইস,মাটন তো ছিলই সাথে ছিল পায়েস।
সকালে ঘুম ভাঙল একটু দেরিতে।আজ মালপত্র নিয়ে বেরোনোর তাড়া নেই।সারাদিন এখানেই কাটবে।নিয়ম মতো ঘরেই সকালের চা পেয়ে যাই।কাপ হাতে লাউঞ্জে গিয়ে বসি।রোদ্দুরের ছোঁয়ায় হিমালয় ঝকমক করে উঠেছে।রোদ্দুরের ওম মেখে নিতে নিতে চায়ের কাপে চুমুক দিই।আজ সবাই বেশ গড়িমসি করছে।সকালে স্থানীয় মন্দিরে যাওয়ার কথা আছে।স্নান করে জলখাবার খেয়ে বেরোতে একটু বেলা হল।বাস আমাদের যেখানে নামিয়ে দিল সেখান থেকে আধ কিলোমিটার উপরে মন্দির।স্বাভাবিকভাবে বয়স্ক লোকজন অতটা উপরে উঠতে উৎসাহী হলেন না।কারোর বুক ধড়ফড়, কারোর শ্বাসকষ্ট, কারোর বা হাঁটু-কোমরে ব্যাথা বয়সকালের নানান প্রতিবন্ধকতা।
নবীনরা এসব থোড়াই কেয়ার করে, তাদের অফুরন্ত দম আর জীবনীশক্তি।তারা টগবগিয়ে পাহাড় চড়তে শুরু করল।তাদের গাইড স্থানীয় কেউ নয় একমেবাদ্বিতীয়ম পিউ।আমরা যারা নীচে পড়ে রইলাম তারা সময় কাটানোর জন্য চায়ের দোকান লাগোয়া বেঞ্চগুলোতে বসে পড়ি।এখানে অবশ্য সময় কাটানো কোনও সমস্যা নয়।প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেই কীভাবে সময় পার হয়ে যায় বোঝা যায় না।চায়ের কাপ হাতে কিছুটা গল্পগুজব করে উঠে পড়ি।আমি আর পুঁটে দুই বাল্যবন্ধু ছেলেবেলার মতো হাত ধরাধরি করে অচেনা পথের দিজে হাঁটি।খানিক উঁচুনীচু পথ পেরোতেই নির্জনতা ঘিরে ধরে।ডানদিকে পাহাড় জুড়ে জঙ্গল, বাঁদিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে অনেক নীচুতে।পা পিছলে গেলে সহজ ল্যান্ডিং।যদিও সেটা সেফ ল্যান্ডিং হবে না একথা বলাই বাহুল্য।রোদ্দুর-ছায়ামাখা পথ পাখির কলতানে ভরে আছে।উল্টোদিক থেকে কয়েকটা স্কুলবালিকা আমাদের পেরিয়ে যায়,বোঝা যায় সামনে জনবসতি আছে।কিছুটা এগোতে রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ উপরে ডানদিকে একটা বাড়ি চোখে পড়ে।সম্ভবত দুই কামরার পাকা বাড়ি,অ্যাসবেসটাসের ছাদ।চারপাশে অনেকটা ফাঁকা জায়গা।সামনের খোলা জায়গায় মধ্যবয়সী মহিলা কাঠপাতা জ্বেলে রান্না করছেন।আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেটাই বাড়িতে ওঠার রাস্তা।এখান থেকে বাড়ি পর্যন্ত দু’ধারেই লাউমাচার মতো মাচা।লাউ-কুমড়োর মতো লতানে গাছে ফুল ধরেছে,ফলও।ভালোকরে দেখে বোঝা গেল এগুলো স্কোয়াস গাছ।পুঁটে ছবি তুলে নিল।এখানে পথের দুপাশে গাছগুলো অজস্র মাকড়সার জালে ভর্তি।লালচে মাকড়সাগুলো দেখতে বেশ সুন্দর। ছবি তোলার চেষ্টা করে দুজনেই ব্যর্থ হই।মোবাইলের সীমাবদ্ধতা বোঝা গেল।ভালো ক্যামেরা ছাড়া এই ছবি তোলা দুঃসাধ্য।হঠাৎ একজায়গায় বেগুন গাছের মতো বেশ কিছু গাছ দেখে থমকে দাঁড়াই।
গাছে ছোট ছোট ফল ধরেছে অবিকল মাকড়া বেগুনের ক্ষুদ্র সংস্করণ। সবাইকে দেখাব বলে ছিঁড়তে গিয়ে দেখি অসহ্য কন্টকময়।যাই হোক ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন !’ একথা মনে হতে কোনক্রমে একটাতে হাত দিতেই সেটা ফেটে গিয়ে আঠালো রসে হাত চিটপিট করে ওঠে।স্থানীয় একজন লাঠি হাতে উপর থেকে নামছিলেন আমাকে গাছে হাত দিতে দেখে বলে উঠলেন,” মত ছুঁনা ওহ জহরিলা হ্যায়”।আর মত ছুঁনা, ছুঁয়ে,চটকে বসে আছি যে !কি রকম বিষ কে জানে, একটু ঘাবড়ে যাই।আমার মুখ দেখে তিনি ডরনে কোই বাত নেহি বলে আশ্বস্ত করেন।মু ঔর আঁখোমে হাত লাগাতে বারণ করেন।পানিতে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে বলে উৎরাই পথে তরতর করে নেমে যান।আমরাও কালবিলম্ব না করে টেলএন্ডার ব্যাটসম্যানদের মতো ব্যাক টু প্যাভিলিয়ান। গিয়ে দেখি উপরে যারা গিয়েছিল তারা ফিরে এসে সদ্য দেখে আসা মন্দির,ছোট ঝর্ণা ইত্যাদির বর্ননা দিচ্ছে আর নীচে যারা পড়েছিল তারা করুণ মুখে শুনছে।এসব পালা সাঙ্গ হলে আবার বাসে উঠে পড়া।ফেরার পথে হোটেলে না ঢুকে উল্টোদিকের শাল ফ্যাক্টরিতে ঢোকা হল।তাঁতঘরের মতো এখানে রঙবেরঙের শাল বোনা চলছে।
দুপুরের খাওয়া শেষ হওয়ার পর আবার বেরোনো হল।এবার যাওয়া হবে গান্ধী আশ্রম।লোকমুখে গান্ধী আশ্রম নামে পরিচিত হলেও আসল নাম অনাশক্তি আশ্রম।গান্ধীজি ১৯২৯ সালে এই আশ্রমে দু’সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন।এখানেই তিনি অনাশক্তি যোগ নিবন্ধ রচনা করেন।কৌশানির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গান্ধীজি ভারতের সুইজারল্যান্ড নাম দেন।আশ্রমে ঢোকার মুখে বেশ কয়টি বাঁদর দন্ত বিকশিত করে অভ্যর্থনা জানাল।আশ্রম চত্ত্বর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। শান্ত পরিবেশে ঢুকেই মন ভালো হয়ে যায়।আশ্রমের ছোট ঘরটা ছিমছাম সাজানো।দেয়ালগুলো ছবি ও তথ্যে ভরা।
এখান থেকে ৩৫০ কিলোমিটার হিমালয় রেঞ্জ পরিস্কার দেখা যায়। চৌখাম্বা,নীলকন্ঠ,নন্দাঘুন্টি,ত্রিশুল,মৃগথুনি,নন্দাদেবী,নন্দাঘাট,নন্দাকুট আর পঞ্চচুল্লির চূড়াগুলি স্পষ্ট দেখা যায়।কৌশানি থেকে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখার সেরা জায়গা এটাই।আমরা যখন ঢুকেছিলাম ভিড় কম ছিল,এখন আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছে।প্রায় সবাই ক্যামেরা,মোবাইল তাক করে প্রস্তুত হয়ে আছে।এক তরুণ আপন মনে ড্রইং খাতায় স্কেচ করে যাচ্ছে।সবাই সূর্যাস্তের প্রতীক্ষায়।
দর্শকের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠল। আকাশের জাদুমঞ্চে শুরু হয়ে গেল আশ্চর্য ম্যাজিক।এশুধু রঙের খেলা।হঠাৎ কোথা থেকে মেঘ এসে ত্রিশুল থেকে নন্দাদেবীর সামনে প্রাচীরের মতো থমকে থাকল।কারোরই মন ভরছে না,বিশেষত আমরা যারা মুন্সিয়ারিতে পঞ্চচুল্লির মাথায় সূর্যাস্ত দেখেছি তাদের কাছে আহামরি মনে হচ্ছিল না।কিন্তু কয়েক মিনিট পর দৃশ্য আমূল পালটে গেল।দিগন্তজুড়ে এতগুলো পাহাড়ে রঙের বহমান কোলাজ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখছি।আমরা এক অদৃশ্য জাদুকরের সন্মোহিত দর্শক।এর মধ্যে মেঘ দৃষ্টির আড়াল সরিয়ে দিয়ে চূড়ার বেশ খানিকটা উপরে ভেসে আছে।রঙীন আলোয় তা আরও অপরূপ হয়ে উঠেছে।
চকিতে মনে পড়ে স্কুলবেলার পাঠ্য জগদীশচন্দ্র চন্দ্র বসুর লেখা ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে প্রবন্ধটির কথা।সেখানে এমন কিছু দৃশ্য বর্ননা ছিল না ! তখন ভাবসম্প্রসারণ, ভাবার্থ,সারসংক্ষেপ লেখার জন্য গদ্যাংশ মুখস্থ রাখতে হত।সেই প্রবন্ধের কিছু অংশ এরকম,–” কতক্ষণ পরে সম্মুখে দৃষ্টিপাত করিয়া যাহা দেখিলাম তাহাতে হৃদয় উচ্ছ্বসিত ও দেহ পুলকিত হইয়া উঠিল। এতক্ষণ যে কুজ্ঝটিকা নন্দাদেবী ও ত্রিশূল আচ্ছন্ন করিয়াছিল তাহা উর্দ্ধে উত্থিত হইয়া শূন্যমার্গ আশ্রয় করিয়াছে। নন্দাদেবীর শিরোপরি এক অতি বৃহৎ ভাস্বর জ্যোতিঃ বিরাজ করিতেছে; তাহা একান্ত দুর্নিরীক্ষ্য। সেই জ্যোতিঃপুঞ্জ হইতে নির্গত ধূমরাশি দিগ্দিগন্ত ব্যাপিয়া রহিয়াছে। তবে এই কি মহাদেবের জটা? এই জটা পৃথিবীরূপিণী নন্দাদেবীকে চন্দ্রাতপের ন্যায় আবরণ করিয়া রাখিয়াছে। এই জটা হইতে হীরককণার তুল্য তুষারকণাগুলি নন্দাদেবীর মস্তকে উজ্জ্বল মুকুট পরাইয়া দিয়াছে। এই কঠিন হীরককণাই ত্রিশূলাগ্র শাণিত করিতেছে।”
একসময় রঙের খেলা থেমে যায়।পরিবেশ আরও শান্ত হয়ে আসে শুধু ঘরে ফেরা পাখিদের কূজনে আশ্রম প্রাঙ্গণ জেগে থাকে।
আমরাদের বাসও হোটেল ফিরতি কলরবে মুখরিত হয়ে থাকে।কৌশানি পর্ব শেষ কাল নৈনিতাল।
(ক্রমশ)
ছবিঃ সুপর্ণা রায়চৌধুরী।