দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ শুধুমাত্র লকডাউনে রোখা যাবে না করোনাভাইরাসের সংক্রমণ, এমনটাই বলেছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু)এমার্জেন্সি এক্সপার্ট মাইক রায়ান। কিন্তু ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে লকডাউন ভিন্ন যে গতি নেই সেটাই এদিন স্পষ্ট করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
হু-র ব্যাখ্যা দিয়েই মোদী বলেন, এই মারণ ভাইরাস শরীরে ঢুকলে থাকছে অনেকদিন। একজন আক্রান্তের থেকে হাজারজনের সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাজেই বিপুল হারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রুখতে লকডাউন ছাড়া ভিন্ন রাস্তা নেই।
মঙ্গলবার রাত ৮ টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে গোটা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আজ রাত ১২টার পর থেকে আগামী তিন সপ্তাহের জন্য অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বেরনো কার্যত বন্ধ দেশবাসীর জন্য। মোদী বলেন, ইতালি, ইরান, চিন, আমেরিকা, স্পেনে ভাইরাস মহামারীর আকার নিয়েছে।
ইতালি ও আমেরিকার স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নত। অথচ তারা এই সংক্রমণ ছড়ানো আটকাতে পারেনি। তার কারণ বিপুল স্তরে সামাজিক মেলামেশা। যে সমস্ত দেশ লকডাউনের পথে গেছে অথবা যেসব মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের গৃহবন্দি করেছেন, সেখানেই মহামারী থেকে বেরনোর সম্ভাবনা দেখা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে গ্রামের কোনও মানুষ পর্যন্ত সবাইকে মনে রাখতে হবে। ঘরের লক্ষণরেখা পার করা যাবে না। সংক্রমণের শৃঙ্খল আমাদের ভাঙতেই হবে।”
মহামারী ঠেকাতে ভারতই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে এমনটাই বলেছিলেন হু-কর্তা মাইক রায়ান। কারণ ভারত আগেও দুটো বড় মহামারীর মোকাবিলা করেছে। তবে মহামারী রুখতে লকডাউনই যে আদর্শ পথ এমনটা বলেননি রায়ান। তাঁর মত ছিল, জমায়েত বন্ধ করে পরস্পরকে দূরে রেখে সংক্রমণ ঠেকানো সব সময় সম্ভব হয় না। লকডাউন মন্দ নয়, তবে খুব একটা কার্যকরীও নয়, এমনটাই জানালেন মাইক রায়ান।
তাঁর মতে, সার্স-সিওভি-২ এর মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গেলে সবচেয়ে আগে দরকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
কোনও মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন কিনা সেটা খুঁজে বার করে তাঁকে আগে আইসোলেশনে পাঠানো। তারপর দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা। সংক্রামিত রোগীকে যদি পাঁচজনের থেকে আলাদা না করা যায়, তাহলে তাঁর থেকেই সংক্রমণ ছড়াবে বাকিদের মধ্যেও। বিকল্প পথ হিসেবে ভারতে ল্যাবোরটরি ও কোভিড-১৯ এর পরীক্ষার জন্য টেস্ট-কিট বাড়ানোর কথা বলেছিলেন তিনি।
ভারত এখন সংক্রমণের নিরিখে স্টেজ-২ তে রয়েছে। অর্থাৎ সামাজিক স্তরে মেলামেশায় সংক্রমণ ততটা বাড়েনি। তবে পরিস্থিতি সঙ্কটজনক হতে পারে যদি সংক্রমণ স্টেজ-৩ বা স্টেজ-৪ এ পৌঁছয়। এর অর্থ হল সামাজিক স্তরে সংক্রমণ ছড়িয়ে মহামারীর আকার নেওয়া।
যেটা হয়েছে চিন, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, এই সামাজিক মেলামেশা যদি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া যায়, তাহলেই এই সংক্রমণকে গোড়াতেই ঠেকিয়ে রাখা যাবে। না হলে গোটা দেশের জন্যই এই ভাইরাস বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ভারতে লকডাউন জারির হওয়ার পরে নানা প্রশ্নের মুখে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তিকেই সমর্থন করেছিল ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ। কারণ হিসেবে তারা বলেছিল, বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণকে ঠেকাতে হলে সচেতনতার পাশাপাশি সামাজিক স্তরে মেলামেশাও বন্ধ করে দিতে হবে।
কারণ সংক্রমণ যদি সামাজিক স্তরে গিয়ে ঠেকে (Community Transmission)তাহলে সেই সব রোগীর চিকিৎসা করার জন্য বা সংক্রমণ সন্দেহে আসা মানুষজনকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠাবার মতো জায়গার ঘাটতি রয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ডেটা বলছে, হিসেব করে দেখতে গেলে ভারতে ৮৪ হাজারের জন্য বরাদ্দ একটামাত্র আইসোলেশন বেড। যদি কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে হয়, তাহলে একটা বেড ধার্য প্রতি ৩৬ হাজার দেশবাসীর জন্য।
করোনার সংক্রমণ মহামারী হয়ে দেখা দেয় তাহলে চিকিৎসা করার মতো ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও অভাব রয়েছে এ দেশে। দেখতে গেলে প্রতি ১১,৬০০ জনের জন্য ডাক্তার রয়েছেন একজন। আর প্রতি ১,৮২৬ জন রোগীর জন্য হাসপাতালের বেড রয়েছে একটি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে লকডাউনই একমাত্র উপায় দেশ ও দেশবাসীকে সুরক্ষিত রাখার।
ক’দিন আগে দিল্লিতে কী হয়েছিল মনে পড়ে? ‘জয় করোনা’ স্লোগান দিয়ে গোমূত্র পানের ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করেছিল বিশ্বহিন্দু পরিষদ। তাঁদের এক নেতা বলেছিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে প্যাকিং করে গোমূত্র পাঠাবেন। গোমূত্রের ডিফেন্সে আটকে যাবে করোনা।
সপ্তাহ দুই আগের কথা? আসানসোলে লাইন পড়ে গিয়েছিল। কেন? করোনা ভাইরাস প্রতিষেধক টিকা খেতে। তারপর পুলিশ গিয়ে লাঠি উঁচিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে।
সেই গোমূত্র ছড়িয়ে পড়েছিল ডানকুনি থেকে দ্বারভাঙা, জোড়াসাঁকো থেকে জব্বলপুর পর্যন্ত। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় করোনাভাইরাস নিয়ে জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় অন্ধবিশ্বাস দূরে সরিয়ে রাখতে বললেন প্রধানমন্ত্রী। সেইসঙ্গে সতর্ক করে বললেন, “গুজব ছড়াবেন না, কোনও গুজবে কান দেবেন না।”
এদিন প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সমস্ত অন্ধবিশ্বাসকে দূরে সরিয়ে রাখুন। চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না।” এখানেই থামেননি মোদী। দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তা করলে আপনার বড় বিপদ হতে পারে।”
করোনাভাইরাস সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙতে আজ মধ্যরাত থেকে ২১দিন সারা দেশে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “এই ২১ দিন বাইরেটা কী জিনিস সেটা ভুলে যান। যাই হয়ে যাক ঘরে থাকুন।” জনতা কার্ফুর থেকে এই কার্ফু যে আরও কঠিন তাও উল্লেখ করেন মোদী।
সেইসঙ্গে বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবেই পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। তাঁর কথায়, “এটা সবার জন্য বলবৎ হবে। প্রধানমন্ত্রী থেকে আমজনতা সবার জন্য এক নিয়ম। সবাইকে থাকতে হবে ঘরের মধ্যে।”