রোমান্টিক দীঘা

0
1314

সুজন আর পরমার বিয়ে হয়েছে দুর্গাপুজোর কয়েক দিন আগে । বৃষ্টির ভ্রুকুটি কে উপেক্ষা করে দীপাবলি যেতেই তাদের মনটা ছুটেছে কাছে-দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে..

প্রেমটা পুরোনো হলেও বিয়েটা যেহেতু নতুন ই তাই পুজোর গিফ্ট হিসাবে সুজন সারপ্রাইজ দিতে পরমাকে নিয়ে পাড়ি দিতে চায় নিকটবর্তী মনোরম ও নিরিবিলি সমুদ্র সৈকত দীঘা, মন্দারমনি ও তাজপুর । পুজোর কটা দিন দুজন দুজনকে নির্জনে আরও একবার নতুন করে চিনে নেওয়ার সুযোগ, এর থেকে আর ভাল কোথায় পাওয়া যাবে? সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় নিজেদের না বলা কথা গুলো পেঁজা তুলোর মতো নীল আকাশে ভেসে ভেসে চলে যাবে দূর থেকে বহু দূরে ,আর ওরা তাই চোখ মেলে দেখবে ।

দীঘা:

রাতের বাস ছুটে চলেছে হুহু করে দীঘার দিকে । এই নাইট জার্নি টা সুজনের খুব পছন্দ ৷ আর যদি সাথে থাকে মনের মানুষ তাহলে তো কথা ই নেই ,রাত টা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে , রাস্তা গুলো কেমন যেন গল্প বলতে থাকে । ধর্মতলা থেকে ৫ ঘন্টায় দীঘা পৌঁছে দেয় যে লাক্সারি বাস গুলো তার ই একটার অগ্রীম বুকিং করে রেখেছিল সুজন। হালকা চালে গান চলছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাসটার অন্দরে । পরমা এক্সাইটমেন্ট ধরে রাখতে পারেনি বলে একসাথে অনেক কথা বলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । তার ঘুমন্ত মুখটায় বাসের নাইট ল্যাম্পের আলো এসে পড়ে তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ৷ একদৃষ্টে তাকিয়ে সেটা প্রান ভরে উপভোগ করছে সুজন।

সকাল হতেই ওরা চলে এল পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র ব্রাইটন অফ্ দ্য ইস্ট দীঘা বীচ । সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ কে উপেক্ষা করে পরমা সুজন কে বলে দিল দীঘা বীচ কিন্তু আবিষ্কার করেন ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮০ সালে । আর ১৮২৩ সালে এক ইংরেজ পথিক পথ হারিয়ে বীরকুল বলে একটা স্থল আবিষ্কার করেন , তার পর ড: বিধানচন্দ্র রায় ৪ কিমি অঞ্চলে গাছ লাগিয়ে দেন । এই হল আজকের নিউ দীঘ৷
যেখানে তারা দুজনে হাত ধরাধরি করে এখন খালি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে বালির মধ্যে । সুজন এতক্ষণ বাধ্য ছাত্রের মতো সব শুনছিল মন দিয়ে , কিন্তু এবার হাতের এক আচমকা টানে পরমাকে নিজের কাছে টেনে নিল । সকালে সূর্যোদয়ের সময়ের গাঢ় কমলা রঙের সূর্য আর দূর থেকে ভেসে অাসা নুলিয়া দের ছোট নৌকা গুলোকে সাক্ষী রেখে দিনের প্রথম ভালবাসার পরশ পেয়ে পরমা লজ্জা পেয়ে গেল খুব ।

অসীম নীলাকাশ আর সীমাহীন বারিধির মাঝে দুজনে দাঁড়িয়ে । মাইল খানেক জুড়ে বেলাভূমি আর পিছনে ঝাউ এর বন ওদের ঘিরে রেখেছে । কোনো জনমানব নেই এখন , একটু পরে দেখতে দেখতে পর্যটক দের ভিড় বাড়তে লাগল । বিশাল ঢেউ গুলো যেখানে ভাঙছে সেখানে বসে ওরা মানুষের হুটো পাটি করে স্নান করা দেখছে । পরমা হাতের বালি দিয়ে একটা বাড়ি বানানোর বৃথা চেষ্টা করে চলেছে । তাই দেখে সুজন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে,ভাগ্যিস এটা পরমার চোখে পড়েনি ।

আজ দিনটা ঝকঝকে তাই ওরা ঠিক করল আজই দীঘাটা ঘুরে দেখে নেবে । প্রথমেই ওরা চলল কৃত্রিম লেক অমরাবতি , পাশেই নতুন করে তৈরী হয়েছে ছোট খাটো একটা সর্পউদ্যান । সেখান থেকে মেরিন অ্যাকোরিয়াম ঘুরে ওরা চলে এল দীঘার এখনকার আকর্ষণ দীঘা সায়েন্স পার্ক । সেখানে কিছুক্ষন কাটানোর পর একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে ওরা রওনা দেবে শঙ্কর পুরের দিকে ।

শঙ্করপুর :
হালকা নীল রঙা সিফনের শাড়ী আর স্লিভলেস গাঢ় নীল রঙের ব্লাউজে পরমা কে খোলা চুলে দেখে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেছিল সুজন । খোলা চুলে কানের একপাশে রাস্তার ধারে নীল রঙের একটা বুনো ফুল তুলে নিজেই গুঁজে দিল সে । পরমাকে এরকম সুন্দর লাগতে আগে কখনও দেখেনি সে কিন্তু কি যেন একটা কমতি আছে তার সাজে । খুব মন দিয়ে দেখেও যেন ও ঠিক বুঝল না ও ।
দীঘা থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ১৩ কিমি দূরে ওরা দুপুর দুপুর বেড়িয়ে পড়ল শঙ্করপুরের উদ্দেশ্যে । মৎস প্রকল্পের জন্য বিখ্যাত শঙ্করপুর সেখানে ভেড়িতে মাছ ধরার অভাবনীয় রীতি দেখে ওরা দুজনেই ছেলে মানুষের মতো হাত দিয়ে চিনিয়ে চিনিয়ে মাছের নাম বলতে লাগল । সে মজা অবর্ননীয় তাদের কাছে ।

ঝাউ ও কেয়ায় ছাওয়া সবুজেরবন ….মাইলেরপর মাইল সারি সারি ঝাউ গাছ । তেমন ই পরিত্যাক্ত জাহাজ রুপোলি ধূ ধূ বালিয়ারি ,বিকেলের রোদে সব যেন ঝকঝক করছে । সামনে নীল আকাশের রঙে গোলানে বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলরাশি । নিরালা সাগর হেলায় ভারতের বৃহত্তম জেটি হয়েছে তা দেখছিল ওরা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে । সারা বীচে ছড়িয়ে আছে লাল রঙের হারমিট ক্রাব অর্থাৎ সন্ন্যাসী কাঁকড়া । তারা ও নাকি বালির গর্ত ছেড়ে উপরে উঠে আসে একমাত্র সঙ্গীর খোঁজে ।

প্রশান্ত বীচে বালি শক্ত হয়ে আছে কোথাও কোথাও । আর দূরে দেখা যাচ্ছে নীল রঙের আকাশের নীচে ঘোলা সমুদ্রের জলের উপরে কালো রঙের স্যিলুয়েটে বালিয়ারির সারি ।
হঠাৎ আঁচলে টান পড়তে পরমা ঘুরে দেখল স্থানীয় নুলিয়া দের একটি মেয়ে মাথায় এর মস্ত ঝাঁকায় ঝিনুকের হার মালা কানের দুলের পসরা সাজিয়ে নিয়ে এসেছে বিক্রি করবে বলে সে ডাকছে পরমাকে যদি সে কিছু নেয় । কচি কিন্তু ব্যবসায়ী গলায় সে জানাল সে আর তার ভাই বোনেরা মিলে এই ঝিনুকের গয়না কিনে বিক্রি করে । দূরে আর ও কটা কচি কচি মুখ ওরা দেখতে পেল ,তারা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি ।

সুজনের কি একটা মনে পড়তেই সে চটপট হাতের কানের ওগলার ঝিনুকের গয়না কিনে একে একে পরমা কে পড়িয়ে দিতে লাগল । এবার যেন ওকে সম্পূর্ন লাগছে , এই টুকু খামতি ছিল ওর সাজের । ওদের কান্ড দেখে কচিরা তো হাসেই অস্থির । পরমার রাঙা হয়ে যাওয়া লাজুক মুখটা তুলে দেখল সেটাও সূর্যাস্তের আভায় আর ও লাল হয়ে গেছে ।
(ক্রমশ)

Previous articleআজ থেকেই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হচ্ছে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ,হারাল রাজ্যের মর্যাদা
Next articleবনগাঁর নাগরিকদের অভাব, অভিযোগের কথা সরাসরি শুনলেন পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্য

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here