দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ করোনার চিকিৎসায় রেমডেসিভির ওষুধ তৈরির অনুমতি দিল মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট গিলিয়েড সায়েন্সেস। বিশ্বের ১২৭টি দেশের ফার্মা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে গিলিয়েড সায়েন্সেস যার মধ্যে রয়েছে ভারতের তিন সংস্থাও।  সিপলা, হেটেরো ল্যাব ও জুবিল্যান্ট লাইফসায়েন্সেসের সঙ্গেও চুক্তি হয়েছে মার্কিন ফার্মা জায়ান্টের।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের উদ্যোগে ভারতে রেমডেসিভির ওষুধের উপকরণ বানানো শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের অধীনস্থ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর)-এর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল টেকনোলজি (সিএসআইআর-আইআইসিটি)-র ল্যাবে রেমডেসিভির ওষুধ তৈরির মূল উপকরণগুলো বানানো শুরু হয়েছে। এবার গিলেড সায়েন্সেসের সঙ্গে জরুরিকালীন চুক্তির ভিত্তিতে ভারতের তিন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি সিপলা, হেটেরো ল্যাব ও জুবিল্যান্ট লাইফসায়েন্সেস-এ বাণিজ্যিক হারে রেমডেসিভির ওষুধ তৈরি শুরু হবে।

ইবোলা সারাতে তেমন কার্যকরী প্রভাব না দেখালেও করোনার চিকিৎসায় কাজে দিচ্ছে রেমডেসিভির, ক্লিনিকাল ট্রায়ালের পরে এমন দাবি করেছে আমেরিকা। এই ওষুধের নির্মাতা সংস্থা গিলিয়েড সায়েন্সেস সাড়ে পাঁচ হাজার রোগীর উপরে এই ওষুধের ট্রায়াল চালাচ্ছে। সেই ট্রায়ালের প্রথম দফার রিপোর্ট বেশ ভালর দিকে বলেই দাবি  করা হয়েছে। গিলিয়েড সায়েন্সসের সিইও ড্যানিয়েল ও’ডে জানিয়েছেন, করোনার সংক্রমণ কমাতে রেমডেসিভিরের সন্তোষজনক ফল দেখা যাচ্ছে। তাই বিশ্বজুড়েই এই ওষুধের ট্রায়াল শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। চাইলে জরুরিকালীন চুক্তির ভিত্তিতে যে কোনও দেশই এই ওষুধ তৈরি বা তার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করতে পারে।

কোন কোন দেশের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে গিলিয়েড সায়েন্সেসের?

মার্কিন ফার্মা জায়ান্ট জানিয়েছে, বিশ্বের ১২৭টি দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। ভারতের তিন সংস্থা ছাড়াও রয়েছে পাকিস্তানের ওষুধ নির্মাতা সংস্থা ফিরোজসন্স ল্যাবোরেটরিস ও পেনসিলভানিয়ার ফার্মা কোম্পানি মাইল্যান। আরও পাঁচটি সংস্থাকে নিজেদের চাহিদা ও সুবিধা মতো ওষুধের দাম ঠিক করার অনুমোদনও দিয়েছে গিলেড সায়েন্সেস।

২০১০ সালেই এই ওষুধ তৈরি করে গিলিয়েড সায়েন্সেস। ২০১৪ সালে আফ্রিকাতে মহামারী হয়েছিল ইবোলা। ২০১৬ সাল অবধি হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সংক্রমণে। সেই সময় রেমডেসিভির নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। অনেকে দাবি করেছিলেন ইবোলার সংক্রমণ রুখতে কাজে এসেছিল এই ড্রাগ, আবার অনেক গবেষকের দাবি ছিল ইবোলার সংক্রমণ সেভাবে আটকাতে পারেনি রেমডেসিভির। তাই সেই সময় এই ড্রাগকে পরীক্ষার স্তরেই রাখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে গিলিয়েড সায়েন্সেস দাবি করেছিল সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম)ও মার্স (মিডল ইস্ট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম) ভাইরাসের সংক্রমণ রুখে দেওয়ার ক্ষমতা আছে রেমডেসিভিরের। আর সার্স-কভ-২ যেহেতু সার্স ভাইরাসেরই অনুরূপ আরএনএ ভাইরাস, তাই কোভিড ঠেকাতেও এই অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ কাজে দেবে বলে দাবি করে গিলেড সায়েন্সেস। করোনা রোগীদের উপর ট্রায়ালেও ভাল ফেলে বলেও দাবি করা হয়। তারপর থেকেই বিশ্বে এই ওষুধের চাহিদা বাড়ে। গিলিয়েড সায়েন্সেস জানিয়েছে, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, মিশর, ফিজি, ঘানা, কেনিয়া, নেপাল, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশও রয়েছে তাদের তালিকায়। এইসব দেশেও রেমডেসিভিরের উৎপাদন শুরু হবে।

করোনায় কীভাবে কাজে দিতে পারে রেমডেসিভির?

রেমডেসিভির নিউক্লিওটাইড অ্যানালগ (Nucleotide Analog)। আরএনএ ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরির ক্ষমতাকে নষ্ট করে দিতে পারে এই অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ। তাই ইবোলার উপরেও এই ওষুধ কার্যকরী হবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু আদতে দেখা যায় ইবোলা আক্রান্তদের উপরে এই ড্রাগ তেমনভাবে কাজ করেনি। সার্স-কভ-২ আরএনএ ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢুকলে দেহকোষে তাদের বাহক প্রোটিন ACE-2 এর সঙ্গে জোট বেঁধে সরাসরি কোষে ঢুকে যায়। একবার দেহকোষে ঢুকতে পারলেই সংখ্যায় বাড়তে থাকে এই ভাইরাস।

প্রতিলিপি তৈরি করে এরা ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরেই। রেমডেসিভির এই প্রতিলিপি তৈরির প্রক্রিয়াকেই বন্ধ করে দেয়। গবেষকরা বলছেন, যতবেশি প্রতিলিপি বানিয়ে ভাইরাস তার সংখ্যা বাড়াবে, ততটাই বেশিবার যে তার জিনের গঠনের বদল ঘটাবে। শরীরের কোষে জেনেটিক মিউটেশন বা জিনের গঠনের বদল হতে থাকবে এই আরএনএ ভাইরাসের। আর জেনেটিক মিউটেশন মানেই ভাইরাস তার আক্রমণাত্মক ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে ফেলবে। এক শরীর থেকে অন্য শরীরে যাওয়ার কৌশল আয়ত্ত করে ফেলবে। রেমডেসিভির এই গোটা পদ্ধতিটাকেই থামিয়ে দিতে পারবে বলেই দাবি গবেষকদের।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে রেমডেসিভির নিয়ে গবেষণা চলছে। এই প্রজেক্টের অন্যতম গবেষক ভারতীয় বংশোদ্ভূত অরুণা সুব্রহ্মণ্যম। তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের ইমিউনোকম্প্রোমাইজড হোস্ট ইনফেকসিয়াস ডিজিজ বিভাগের প্রধান ও চিফ ক্লিনিকাল অফিসার। জানিয়েছেন, দু’টি পর্যায়ে রোগীদের উপর ট্রায়াল শুরু হয়েছে স্ট্যানফোর্ডে। কিছু রোগীর শরীরে পাঁচদিন ধরে একটা নির্দিষ্ট ডোজে রেমডেসিভির প্রয়োগ করা হয়েছে, অন্যদের দশ দিন ধরে ওই ওষুধের ডোজ দেওয়া হয়েছে।

দুই ক্ষেত্রেই একই রেজাল্ট পাওয়া গেছে। পাঁচদিনের কোর্সে যাঁদের রেমডেসিভিরের ডোজ দেওয়া হয়েছিল তাঁদের সংক্রমণ যতটা কমেছে, দশদিনের কোর্স করা হয়েছিল যাঁদের উপরে তাঁরাও একইভাবে উপকৃত। অরুণার কথায়, এই রোগীদের এখনও পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ওষুধ কতটা কার্যকরী হচ্ছে, কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে কিনা সেটা জানার পরেই রিপোর্ট পেশ করা হবে। শিকাগো হাসপাতালেও রেমডেসিভিরের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here