পার্থ সারথি নন্দী,বনগাঁ: ঝড় আসছে শুনে আমার স্ত্রী সকাল থেকে অপেক্ষা করে ছিল। দিনের মধ্যে বার কয়েক প্রশ্ন করেছে,‘‘কখন আসবে ঝড়।’’তাঁর ধারণা, বেশ বড়সড় মতো কিছু হতে চলেছে এবার।আমি তাঁকে প্রশ্ন করি কেন এমন ভাবছো?সময় নষ্ট না করেই জবাব দিল মমতা বলেছে ঘরে থাকতে হবে,বাইরে যাওয়া যাবেনা,তাই কাজেও যাওয়ার দরকার নেই৷ আমিও চুপ করে ভাবলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সাহসী নারী তিনি যখন ঘরে থাকতে বলেছেন তাহলে কিছু একটা ব্যাপার আছে,তাই সকাল থেকেই ঝড়ের অপেক্ষায় ছিলাম।
কিন্তু ঝড় যখন আকাশ জুড়ে নিজের সব শক্তি নিয়ে ঢুকে পড়ল আমাদের গ্রামে, তখন আমার স্ত্রী কল্পনা সহ আরও পাঁচ সদস্য ভয়ে কাঁপছে। কল্পনা আমার কাছে এসে এক হাতে খাটের পায়াটা খুব জোরে ধরে রেখে বললো‘‘ঝড় কখন থামবে!’’মমতা এই জন্যই বাইরে যেতে না করেছিল।
এক ঘরে আমরার পরিবারের সব সদস্য মাথা নিচু করে গাঁঘেষে চুপ করে বসে আছি,বাইরে প্রবল শব্দ। দরজা-জানলা এঁটেও মনে হচ্ছিল মাথার উপর দিয়ে ৭১ এর যুদ্ধ বিমান গুলো যেন বোঁ-বোঁ শব্দ করে ছুটে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিক ।পাশে ছোট নাতিটা তার মাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে ঘুমিয়েই পড়ল । আমার বড় ছেলে ঘরের দরজাটা পিঠ দিয়ে চেয়ে বসেছিল,মনে হচ্ছিল বাইরে থেকে কেউ বড় একটা কিছু দিয়ে জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে৷ হঠাৎ মাথার উপর থেকে টিনের চালটা বিকট শব্দ করে রকেটের মতো উড়ে চলে গেল, শুরু হলো বৃষ্টি,প্রায় ৪ঘন্টা তীব্র আতঙ্কের মধ্যেই আমাদের ছোট্ট ঘরে ঝড়ের মধ্যে কাটালাম, কল্পনা (স্ত্রী)গ্রামে কারো কাছে শুনে ছিল,টিভিতে নাকি মমতা সবাইকে ঘরে থাকতে বলেছিল!আমরা তাই ঘরেই ছিলাম৷
বুধবার সকালে যখন শুনেছিলাম, ঝড়ের গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ১২০-১৩০ কিলোমিটার। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না কথাটা। মনে হচ্ছিল, অন্যবারের মতো এ বারও হয় তো শুধু লেজের ঝাপটা টুকুই আসবে এই বাংলায়। অন্তত উপকূল থেকে এত দূর বনগাঁ শহরে নিশ্চয়ই বড় কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না আমপান। চিত্র সাংবাদিকতার পেশায় দীর্ঘ দিনের যেটুকু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে তাতে ঠাকুরনগরের টরনেডো,আয়লা, ফণী,ছিল কাজের তালিকায়, এবার আমপান সবাইকে টপকে গেল। চোখের সামনে দেখলাম সত্যিই এবার বনগাঁ শহরটাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে গেল আমপান ঝড়ের দাপট।
সন্ধ্যা ৬ টার পর থেকে হাওয়ার দাপট বাড়তে শুরু করল । সেই সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। পুলিশ সূত্রে জানতে পারলাম, যশোর রোডে একটি দুধের গাড়ি উল্টে গিয়েছে। বিভিন্ন এলাকার বাড়ি এবং দোকানের টিনের চাল উড়ে গিয়েছে। ডাল চাপা পড়ে জখম হয়েছেন কয়েক জন। একটি পঞ্চায়েত অফিসের জানলা ভেঙে গিয়েছে। তখন ছিল এটা সিনেমার ট্রেলার মাত্র। পুরো ‘পিকচার’ বাকি।
রাত সাড়ে ৮টা ৩o থেকে শুরু হল আসল দৌরাত্ম্য। রাত তখন ৯ টা। ঘরে চার্জার লাইট জ্বেলে বসে আছি। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের ফোন করে ঝড়ের গতিপ্রকৃতি জানার চেষ্টা করছি। পরিচিতরা অনেকেই ফোন করে আমার কাছ থেকেও তথ্য জানতে চাইছেন। সকলেরই প্রশ্ন একটাই, কখন থামবে এই ঝড়। যদিও আমার কাছেও তখন এর কোন সঠিক উত্তর ছিলনা আশার কথা শুনতে পাচ্ছি না কোনও দফতর থেকে।শুধু বলে ছিলাম চলবে আরও কিছুক্ষণ, সাবধানে থাকুন,সাহস রাখুন৷
এরই মধ্যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নিজস্ব চিত্র গ্রাহক (সিনিয়র চিত্রসাংবাদিক) অশোক মজুমদার নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকের ছবি পাঠালেন, এবং নবান্ন সূত্রে তথ্য পেলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন “সর্বনাশ হয়েগেছে” ধ্বংস হয়ে গেছে দু’ই চব্বিশ পরগনা!এবার আমিও বেশ চিন্তত হলাম, নিজের পরিবারের সকলের মুখের দিকে একবার তাঁকালাম, কিন্তু ভাব প্রকাশটা এমনই ছিল যেন তেমন কিছুই নয়, ঝড় থেমে যাবে চিন্তার কোন কারণ নেই।আসলে তাঁদের মনে সাহসটাকে ধরে রাখার উদ্দেশ্য মাএ।
বনগাঁর মহকুমাশাসকের দফতর সূত্রে জানতে পারলাম, বনগাঁয় তখন ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ চলছে ঘণ্টায় ১৩২ কিলোমিটার। ক্যামেরা হাতে ঘরের দরজা খুলে বাইরে এলাম একবার।শব্দ শুনে বুঝলাম , টিনের চাল উড়ছে বাতাসে। ভেঙে পড়ছে গাছের ডাল।এই অন্ধকারে কোন ভাবেই ছবি তোলা সম্ভব হলনা, কারণ তখন কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ নেই বাইরে চুল কালো অন্ধকার, সব রাস্তা , বাড়ির আলো নিভে গেছে,যে গুলো জ্বলছে তা ঘরের ভিতরে খুবই সামান্য তার কোন রেশনেই বাইরে৷
তীব্র ঝড়ের ঝাপটায় ফের ঢুকে পড়লাম ঘরে। মনে হচ্ছিল, পুরো বাড়িটাই হয়তো এবার উড়ে যাবে ঝড়ে। দূর থেকে কিছু সময় অন্তর ভেসে আসছিল শাঁখ-ঘণ্টা-উলুধ্বনির শব্দ। অনেক মানুষের মনের বিশ্বাস নিয়ে তাঁরা হয়তো ঝড় থামানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন । কিন্তু কোথায়ও তাণ্ডব কমার কোনও লক্ষণই ছিল না।ঝড়ের গতি যখন কমল, তখন রাত প্রায় সাড়ে ১১টা৩০। তবে এদিন সারা রাত চলছিল ঝোড়ো হাওয়া। বনগাঁ, বাগদা, গাইঘাটা থেকে ধ্বংসলীলার খবর আসতে শুরু করেছিল ঝড়ের মধ্যেই। কারও বাড়ি ভেঙেছে। কারও বাড়ির উপরে গাছ ভেঙে পড়েছে। উড়েছে টিন-অ্যাসবেস্টসের চাল। পাকা বাড়ির জানলার কাচ তো ঝনঝন করে ভাঙছে, অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতেই শুনতে পাচ্ছিলাম সেই ভাঙার তীব্র শব্দ।
সহকর্মী চিত্র সাংবাদিক রতন সিনহা, প্রদীপ দে,সোমা দেবনাথ ‘রা বললেন, তাঁদের বাড়ির সামেনে যশোর রোডের প্রাচীন গাছের বড় বড় ডাল ভেঙে ভেঙে পড়ছে, পাড়ার বিদ্যুৎ এর খুঁটি গুলো বাড়ির দেওয়াল আর পাঁচিলে
গিয়ে পড়ছে টুকুরো টুকরো হচ্ছে জানলার কাচ।
বৃহপতিবার ভোর বেলায় বেরিয়ে দেখি, চারপাশটা ধ্বসংস্তূপে পরিণত হয়েছে, মনে পড়লো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার প্রেসমিটে বলেছিলেন “সর্বনাশ হয়েগেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে”! চাক্ষুষ দেখলাম কত কী যে ভাঙা জিনিসপড়ে যশোর রোডে। বিদ্যুতের বহু খুঁটি ভেঙেছে। বনগাঁ ছয়ঘরিয়া গ্রামে বড় বড় গাছ ভেঙেছে, শুয়ে পড়েছে সবজী ক্ষেত। কোথাও উড়ে গেছে গোটা ঘরটাই৷বহু দোকানের হোর্ডিং ভেঙে রাস্তায় পড়ে। মনে হচ্ছিল, ছয়ঘরিয়ার রণজিৎ বারুই এর কথাই ঠিক-রাতের অন্ধকারে কোন বোমারু যুদ্ধ বিমান এসে তছনছ করে দিয়ে গিয়েছে আমার শহর-গ্রাম বনগাঁয়।