“অশোক মজুমদার”

করোনার সঙ্গে যুদ্ধের মাঝখানে চলে এল আরেকটা যুদ্ধ। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত অর্কভ বিশ্বাস নামে একটি শিশুর প্রাণ বাঁচানোর লড়াই। ১০বছরের শিশুটির বাবার নাম মাধব বিশ্বাস, মায়ের নাম রিম্পা। এরা থাকেন ভাঙড়ের পোলেরহাটে। ১৫ দিন অন্তর রক্ত দিতে হয় অর্কভকে। লকডাউনে আমরা সবাই যখন নাজেহাল তখন এই অবস্থায় থাকা একটি শিশু ও তার মা বাবার অবস্থাটা সবাই বুঝতে পারছেন। ২৫০০টাকা দিয়ে রক্ত কিনতে হচ্ছে, তা পেলেও দেওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। স্বাভাবিকভাবে সরকারি হাসপাতাল এখন করোনা নিয়ে ব্যস্ত। বেসরকারি হাসপাতালের খরচ বহন করা পরিবারটির পক্ষে সম্ভব নয়।

করোনা আক্রান্ত সময়ে আমার ‘মানবিক পরিষেবা’ নামে নিজস্ব সহায়তা প্রচেষ্টার খবর পেয়ে কিছুদিন আগে মাধব আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে তার ছেলের রক্ত দেওয়ার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করার কথা জানান। বলেন, ৪ তারিখে আমার ছেলেকে রক্ত দিতেই হবে। গ্রামের বাড়িতে সিস্টার আসতে চাইছে না। আত্মীয়স্বজনরা করোনার ভয়ে ঘর দিচ্ছে না। গাছতলায় তো রক্ত দিতে পারবো না! আমার ছেলেটা হয়তো মারা যাবে। মাধব ফোনে কাঁদছিলেন। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে করবো তা নিয়ে আমার স্ত্রী নিবেদিতার সঙ্গে আলোচনা করলাম।

সে এখন ফর্টিস হাসপাতালের এর ইনফেকশনাল কন্ট্রোল ডিরেক্টর। একসময় যুক্ত ছিল আর্মি হাসপাতালের সঙ্গে। মাধবের সমস্যার কথা শুনে নিবেদিতা বললো, দেখো আমাদের বাড়িতে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ডাক্তার ডাকতে হবে। কারণ কোন জটিলতা হলে সামলানো যাবে না। তাছাড়া এই করোনার সময় বাড়িতে বাইরের মানুষের আসা নিষিদ্ধ।

ফোন করলাম ডাক্তার বন্ধুদের। তারা সবাই বললো, ডাক্তার ছাড়া বাড়িতে রক্ত দেওয়া যায়না। করোনারও ভয় দেখালো তারা। আমি নিজেও একটু ভয় পেলাম। সত্যিই তো একে করোনা, তার ওপর বাড়িতে ডাক্তার ছাড়া প্রায় ৪ঘন্টা রক্ত দেওয়া। মাধবের সঙ্গে আর যোগাযোগ করলাম না।

কয়েকদিন পর রাতে মাধবের হঠাৎ ফোন, কান্না জড়ানো গলায় সে বললো, স্যার, একটা কিছু করুন। আমার অসহায়তার কথা তাকে জানিয়ে বললাম, কী করবো আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। ডাক্তার তুমি আনতে পারবে না। সিস্টারকে দিয়ে প্রায় ৪ ঘণ্টা রক্ত দেওয়ার ঝুঁকি নিতে পারবো না আমিও। যদি কিছু হয় আমরাও বড় বিপদে পড়ে যাবো। একটু চুপ করে থেকে মাধব কান্না জড়ানো গলায় বললো, স্যার, আমি ছেলেটাকে বাঁচাতে পারবো না।

আগেই বলেছি আমার গ্রামের বাড়িতে কোন সিস্টার যেতে চাইছে না। সরকারি হাসপাতাল একের পর এক ডেট দিচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আপনি কলকাতায় থাকেন সেই ভরসাতেই আপনাকে বারবার ফোন করছি। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব এমনকি আত্মীয়স্বজনরাও করোনার ভয়ে হাত তুলে নিয়েছে। এই কথোপকথন গত ৬ তারিখ রাতে।

আমি ‘মানবিক পরিষেবা’ দেওয়ার কথা যখন ভেবেছিলাম তখন ভাবনাটা শুধু চাল, ডাল, তেল, নুন, ডিম দেওয়াতেই আটকে ছিল। কিন্তু এমন একটা সমস্যার কথা আমার কল্পনাতেও আসেনি। রাতে ঘুম এল না, সকালে উঠেই নিবেদিতাকে সমস্যাটার কথা বলতেই উত্তর এল, যথেষ্ট বয়স হয়েছে, যা করবে ভেবেচিন্তে কোরো। বারবার বলছি, ডাক্তার ছাড়া রক্ত দেওয়া আমি সমর্থন করতে পারি না।

কী করা যায় ভাবতে গিয়ে আমার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি সেখানে ৮টি পরিবার থাকে। পরোপকার করতে গিয়ে এইসময় আমার পাশাপাশি তাদেরও বিপদ হতে পারে। একদিকে অর্কভের মুখ, মাধবের মুখ, রিম্পার মুখ, অন্যদিকে ডাক্তার, করোনা আর নিজের পরিবারের মুখের মিছিল চলে যাচ্ছিল আমার মনের ওপর দিয়ে। আশা-নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে ভাবছিলাম, ভগবানের ওপর ভরসা থাকলে তিনি হয়তো এসময় পথ দেখাতে পারতেন। আমার তো আবার ছোট থেকেই তার সঙ্গে ঝগড়া।

জীবনে এত কঠিন পরীক্ষায় কোনদিন আমায় পড়তে হয়নি। সব দিক ভেবে মাধবকে বললাম, কাল (৮ই এপ্রিল) তুমি ছেলেকে নিয়ে আমার বাড়ি চলে এসো। আমি সামলে নেবো। ধরা গলায় মাধবের উত্তর এল, আমি জানি আপনাকে বিপদে ফেলছি, অনেক মানুষের কাছে ছোট করছি, নিয়ম ভাঙছি, কিন্তু আমি নিরুপায়।

স্ত্রী নিবেদিতা সকাল থেকে চুপ, আমি জানি তারও মনে চলছে যুদ্ধ, কাজে বেরোবার আগে দুই ছেলেকে বললো, ওরা যখন আসবেন, তোরা ঘরে থাকবি, চলে যাওয়ার পরে সবকিছু পরিষ্কার করবি। বলে নিজেই ওদের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা, শিশুটির জন্য ফল মিষ্টি সব জোগাড় করে বললো, আধ ঘন্টা পরপর যেন ওরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। পুরোপুরি না হলেও অনেকটা আশ্বস্ত হলাম, মনটা একটু হালকা হল।

ঠিক সময়ে মাধব ও রিম্পা আমার বাড়িতে অর্কভকে নিয়ে পৌঁছতেই আমার কয়েকজন প্রতিবেশী গেটে আটকালো তাদের। শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ, কোথায় থাকো, এখন কেন এসেছো, কার কাছে যাবে, জানো না এখন ঘর থেকে বেরোতে নেই? প্রশ্নকর্তাদের হাত ধরে বুঝিয়ে কোন মতে ওদের ফ্ল্যাটে নিয়ে এলাম। সিস্টারও হাজির হলেন ঠিক সময়ে। রক্ত দেওয়া শুরু থেকে শেষ অবধি কোন অসুবিধা হয়নি। রক্ত দেওয়া শেষ হওয়ার পর ওরা ঝোল-ভাত খেয়ে বিকেলে বাড়ি চলে গেল।

আমি জানিনা কাজটা আমি ঠিক করলাম না ভুল। প্রতিবেশীদের ওপর আমার কোন অভিযোগ নেই। কারণ এই সময় ছেলেও মায়ের কাছে যেতে পারছে না। আর আমি অচেনা তিনজনকে এনে বাড়ির ভিতরে এমন একটি কাজ করে ফেললাম। ক্ষমা চাইছি, ভুল করেছি কিন্তু সবটাই কি নিয়মের মধ্যে থাকে? ৪মাস আগে মৌলালির মোড়ে গাড়িতে ধাক্কা খাওয়া এক অফিস যাত্রীকে দেখে আমার মনে হয়েছিল হাজার হাজার লোক রাস্তায় এপারওপার হয়, আজ এই লোকটার প্রাণ গেল। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মানুষটি কি ভেবেছিল যে সে স্ত্রী, সন্তানদের কাছে আর কোন দিন ফিরতে পারবে না। দু’চাকার মোটর সাইকেলে সবথেকে বেশি অ্যাক্সিডেন্ট হয় অথচ তার বিক্রি সবচেয়ে বেশি।

সবসময় মৃত্যু ভয় তাড়া করলে মানুষের পাশে থাকবো কী করে? আমাদের জীবন তো সুতোয় ঝুলছে, এই আছি এই নেই। এতকিছুর পরেও মাধব, রিম্পা, অর্কভের মুখে হাসি দেখে মনে হল, এই পাওয়াটাই তো পরম প্রাপ্তি। জীবন নামে একটা যুদ্ধের ভিতরে লুকিয়ে থাকে এসব ছোট ছোট যুদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here