দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ রাজ্যে এক টানা ৯ বছর সরকার চালানোর পর স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তৈরি হয়েছে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে। বিরোধীরা আজ চুরি, দুর্নীতির অভিযোগ তুলছেন, তো কাল বলছেন আইনশৃঙ্খলার অবনতির কথা, পরশু বলছেন, কুশাসন চলছে বাংলায়।
পরিস্থিতি যখন এমনই তখন মঙ্গলবার ২১ জুলাইয়ের ভার্চুয়াল শহিদ সভা থেকে একুশের ভোটের রাজনৈতিক স্লোগান বেঁধে দিতে চাইলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়—‘বহিরাগতরা বাংলা চালাবে না, বাংলা চালাবে বাংলার লোকই।’
স্পষ্ট করে মোদী-অমিত শাহর নাম অবশ্য মুখে আনেননি দিদি। তবে বলেছেন, বিজেপি চোরেদের দল। টাকা দিয়ে ভোট কেনার চেষ্টা করে। টাকা দিয়ে অন্য রাজ্যে সরকার ফেলে দেয়। সেই সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন, গুজরাতই কি দেশের সব রাজ্য চালাবে? তা হলে নির্বাচন কমিশন ভেঙে দিক। একটা রাজ্যই দেশ চালাক। পরক্ষণেই আবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “দাদা ভাই যদি ভেবে থাকেন, টাকা দিয়ে ভোট কিনে আর কিছু সিপিএমকে হাত করে বাংলা দখল করবেন, তা হবে না।”
৯৩ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী সেই সময়ে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের দাবিতে তিনি ২১ জুলাই মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন। পুলিশের গুলিতে সেদিন ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর মৃত্যু হয়। তাঁদের স্মরণ করতেই প্রতি বছর ২১ জুলাই শহিদ দিবস পালন করে তৃণমূল।
তবে বাংলার রাজনীতি জানে, ২১ জুলাই শুধু শহিদদের স্মরণ করার দিন নয়। দিদি এদিন দলকে হোম টাস্ক দেন। পরের লক্ষ্য বেঁধে দেন। দলকে রাজনৈতিক দিশা দেন। ঠিক যেমন, উনিশের লোকসভা ভোটের আগে আঠারো সালের ২১ জুলাই স্লোগান তুলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ৪২–এ ৪২ চাই, দিল্লিও চাই। একুশের ভোটের আগে মঙ্গলবার সেটাই করলেন দিদি। রাজ্যে এখন প্রধান বিরোধী দল হল বিজেপি। বাংলায় ক্ষমতা দখল করার জন্য প্রতি মুহূর্তে হুঙ্কার দিচ্ছেন মোদী-অমিত শাহর অনুগামীরা। সেই পরিস্থিতিতে আজ দলকে দিদি বোঝালেন, মানুষের কাছে এই বার্তা নিয়েই যেতে হবে যে, বাংলা গুজরাত থেকে চলবে না। বহিরাগতরা চালাবেন না।
পর্যবেক্ষকদের মতে, একে তো এই বার্তার মধ্যে হাইপার রিজিওনালিজম রয়েছে। অর্থাৎ প্রখর আঞ্চলিকতাবাদ রয়েছে। বিজেপি-কে বহির্শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে দিদি দেখাতে চাইছেন, যেন বর্গিরা হানা দিতে চাইছে বাংলায়। তা রুখে দিতে হবে। কিন্তু সঙ্গে অন্য কৌশলও রয়েছে। আম ধারনা হল, বাংলায় বিজেপি অন্যতম প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে ঠিকই। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার মতো বিজেপিতে উপযুক্ত মুখ নেই। দিলীপ ঘোষেদের জনপ্রিয়তা থাকলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো রাজনৈতিক উচ্চতা নেই। ফলে রাজ্য বিজেপিকে মোদী-অমিত শাহর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। তাঁদের ছবি দেখিয়ে ভোট চাইতে হয়। সেই অ্যাডভান্টেজটাই নিতে চেয়েছেন দিদি।
বহিরাগতদের রুখে দেওয়ার পাশাপাশিই বাংলা যে আক্রান্ত সেই বার্তাও এদিন দিতে চেয়েছেন দিদি। অতীতে বামেরা ধারাবাহিক ভাবে এই রাজনীতি করেছেন। তাঁদের অন্যতম অভিযোগই তখন ছিল, বাংলা বঞ্চিত। কেন্দ্র বাংলার সঙ্গে বঞ্চনা করছে। যদিও খাতায় কলমে অনেক সময়েই দেখা যেত, কেন্দ্রের পাঠানো টাকায় ঠিকমতো কাজই করতে পারছে না রাজ্য সরকার। কত টাকার কাজ হয়েছে তার হিসাবও দিতে পারছে না।
তৃণমূলনেত্রীও এদিন অনেকটা সেই বামেদের লাইন ধরেছেন। বক্তৃতায় তিনি বলেন, “শান্তিতে কোনও দিন কাজ করতে পারিনি। কথায় কথায় অপমান করেছে। আমিও একটা মানুষ। যন্ত্র নই। বামেরা যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন রোজ অত্যাচার করেছে। এখন বিজেপি কথায় কথায় অসম্মান করছে। লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছে। কথায় কথায় চক্রান্ত করছে।”
পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, একুশের ভোটের আগে বিজেপি যে তৃণমূলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করতে পারে বলে শাসক দলে যে আশঙ্কা রয়েছে তা এদিন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া সিবিআই, ইডির তদন্তে যে হঠাৎ গতি আসতে পারে তা নিয়েও উদ্বেগে শাসক দল। তবে দিদি এদিন কৌশলে সেটাই আগাম রাজনৈতিক হাতিয়ার করে নিতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিজেপি টাকা সবাইকে কেনার চেষ্টা করবে, এমনকী বুদ্ধিজীবীদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেবে। কেউ যেন সেই ফাঁদে পা না দেন। অর্থাৎ বিজেপি যে সমস্ত রকম অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক কাজ করতে পারে সেই বার্তা এখন থেকেই মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন দিদি।
যদিও এ ব্যাপারে লোকসভায় কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, এ সব নিয়ে কাঁদুনি গেয়ে লাভ নেই। বাংলায় এর পথ দেখিয়েছেন উনিই। টাকা দিয়ে পুরসভা কিনেছেন, জেলা পরিষদ কিনেছেন, পুলিশকে দিয়ে বিরোধীদের জেলে পুড়েছেন। বাংলায় গণতন্ত্র তো কবেই খুন হয়ে গিয়েছে। বিষবৃক্ষ যারা পুঁতেছে, এখন তাদেরই সেই ফল খেতে হবে।