দেশের সময় ওযেবডেস্কঃ রাজ্য শিউরে উঠেছিল একটি খুনের ঘটনায়। উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার সুটিয়ায় খুন হন স্থানীয় যুবক, মধ্য কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস। পিছন থেকে গুলি করে সকলের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যায় দুষ্কৃতীরা। চার ভাড়াটে খুনিকে দিন কয়েকের মধ্যে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১২-র ৫ জুলাই।
সেই সময় তদন্তে উঠে আসে, দমদম সেন্ট্রাল জেলে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক বন্দির কথাতেই নিরীহ যুবককে খুন করা হয়েছিল। মাত্র এই ঠুকুই৷
প্রকৃত প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও, কার নির্দেশে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী বরুণকে খুনের সুপারি দিয়েছিল? বরুণ যে অনেকের আক্রোশের কারণ হয়েছিলেন তা অজানা ছিল না পরিবার এবং প্রিয়জনদের। কিন্তু তার পরিনামে পৃথিবী থেকে তাঁকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল কার? বরুণ কী এমন ক্ষতি করেছিলেন সেই ব্যক্তির?
বরুণের পরিবার রাজ্যের শাসক দলের এক নেতার বিরুদ্ধে খুনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুললেও পুলিশ তা কানে তোলেনি। উল্টে সেই প্রভাবশালী নেতা বরুণের এক দিদির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত সোমবার ছিল বরুণের মৃত্যুর নবম বার্ষিকী। বিগত বছরগুলির মতো এদিনও পরিবার ও প্রিয়জনদের চেষ্টায় বরুণের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের ঘরোয়া আয়োজন হয়েছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বরুণ যে স্কুলে পড়াতেন সেই মিত্র ইনস্টিটিউশন (মেন)-এর একটি প্রেক্ষাগৃহে এদিন নামকরণ করা হয় ‘বরুণ বিশ্বাস স্মৃতিরক্ষা হল’। সেই সঙ্গে বরুণের সময়কার ছাত্ররা স্কুলে জড়ো হয়ে প্রিয় শিক্ষকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে৷
মাত্র ৩২ বছরের জীবনে বরুণ এই প্রান্তিক মানুষদের স্বার্থেই কাজ করার চেষ্টা করেছেন। লড়াই করেছেন তাঁদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে। আর সেই কারণেই প্রাণ দিতে হয় তাঁকে।
সালটা ছিল ২০০০-২০০২, এই সময়টা রীতিমতো দুষ্কৃতীদের স্বর্গ রাজ্য হয়ে উঠেছিল গাইঘাটার সুটিয়া গ্রাম। ধর্ষণ,খুন এর ঘটনা ছিল সুটিয়ার নিত্যঘটনা৷ দু-আড়াই বছরের মধ্যে আনুমানিক ৩২টি ধর্ষণ এবং প্রায় এক ডজন খুনের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের শিকার হন মূলত দরিদ্র পরিবারের শ্রমজীবী মহিলারা। আশ্চর্যের হল, প্রশাসন তো বটেই প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমের সিংহভাগ অংশ এই সব ঘটনায় নিয়ে নীরব থাকতে দেখা যায় ।
স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বরুণ গড়ে তোলেন সুটিয়া গণধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চ। মঞ্চের আন্দোলনে অস্বস্তি বাড়ে তৎকালীন শাসক দল সিপিএম এবং স্থানীয় প্রশাসনের। দুষ্কৃতীদের হুমকির মুখেও চলে আন্দোলন।
প্রশাসনকে আরও চাপে ফেলে বরুণদের উদ্যোগে এলাকার জলাশয় বাঁচানোর আন্দোলন। এলাকার নিকাশি খালের গতিমুখ বদলে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল স্থানীয় একটি প্রভাবশালী অংশ। বরুণরা সেই চক্রান্তের বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু করেন। তাতেও বরুণ ও তাঁর সহযোগীদের উপর আক্রোশ বেড়ে গিয়েছিল প্রভাবশালীদের। বরুণ খুনের পর তাঁর মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক হাজার মানুষ শপথ নিয়েছিলেন খুনের বিচার আদায় করার পাশাপাশি দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তাঁরা। গঠিত হয় বরুণ বিশ্বাস স্মৃতিরক্ষা কমিটি। বরুণের বাড়ির কাছেই বসে তাঁর মূর্তি। কিন্তু আন্দোলন? খুনের বিচার?
বরুণের দাদা অসিত বিশ্বাসের কথায় , কোনও অগ্রগতি নেই। থেমে গিয়েছে আন্দোলন। তাঁরা সিবিআই তদন্ত দাবি করেছিলেন। সে দাবিও মেটেনি। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি আরও বলেন, এখন বুঝতে পারছি, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য তখন ভাইয়ের সঙ্গে অনেকে হাত মিলিয়েছিল। এখন তাঁরা সবাই উধাও ।
প্রতিবাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বরুণ এলাকার দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোয় সাহায্য করতেন। পড়াশুনোর সামগ্রী, প্রাইভেট টিউটরের বেতন ইত্যাদির খরচ দিতেন বহু দুঃস্থ পড়ুয়াকে। অসিত বাবু আরও জানান, সেই কাজটা এখনও চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু আমাদের পাশে সেভাবে আর কেউ নেই। বরং, বিচার চাইছি বলে নানাভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে আমাদের পরিবারকে। তাঁর কথায়, পরিবার এবং অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দু-চারজন ছাড়া একমাত্র বরুণ যে স্কুলে শিক্ষকতা করত সেই মিত্র ইনস্টিটিইউশন এবং সেখানকার ছাত্র, শিক্ষকরা মনে রেখেছে বরুণকে।