পার্থ সারথি নন্দী, বনগাঁ: দেখতে দেখতে পুজো শেষ।নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে এবারের মতো গৌরীকে বিদায়। চিরাচরিত প্রথা মেনে গঙ্গা সহ দেশের বিভিন্ন নদীতে নিরঞ্জন হল দশভুজার। আবার একটা বছরের অপেক্ষা।
এবার ঢাকিদের ঘরে ফেরার পালা শুরু হয়েছে। শুক্রবার দুপুর থেকেই প্রতিমা বিসর্জন শুরু হয়েছে বিভিন্ন নদীর ঘাটে। নিরঞ্জনের পালা চলবে আগামী রবিবার পর্যন্ত। প্রতিমা বিসর্জনের পরে শনিবার ঢাকিদের অনেকেই বিভিন্ন পাড়ায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাঁড়ালেন হাত জোর করে। সাহায্যের প্রত্যাশায়। গৃহস্থরাও ছিলেন মোটামুটি প্রস্তুত। প্রতিবারের মত সাহায্য করলেন যে যাঁর মত। বছরের এই একটা দিন অন্তত কার্পণ্য নেই বেশিরভাগ গৃহস্থের। ঢাক বাজিয়ে সারা বছরের পেটের ভাত জোগাড় হয় না কারও। কারও হয়তো এক-দু’কাঠা জমি আছে। বেশিরভাগই ভূমিহীন খেতমজুর। অপরের জমিতে জনমজুরির কাজ করেন ৷ পশ্চিমবঙ্গে সরকারের জব কার্ডের দৌলতে ‘১০০ দিনের কাজে’ যোগ দিয়ে অনটনের সংসার চলে এপার বাংলার বহু ঢাকি পরিবারের। এই দারিদ্র্যের মধ্যেও শারদোত্সবের এক অন্য আবেদন তাঁদের কাছেও থেকে যায়। কারণ ঢাক বাজিয়ে এককালীন কিছু বেশি উপার্জন হয় এই সময়টায়।
সেই উপলক্ষে নতুন করে ঢাক ছাওয়া হয়। লাগানো হয় চামড়া বা ফাইবারের শিট। পালকের ঝুঁটি দিয়ে ঢাক সাজিয়ে নেন তাঁরা। ঢাকের তালে পুজো মাতিয়েই সুখ পান এপার বাংলার ঢাকিদের দল৷
কিন্তু ওপার বাংলার ঢাকিরা জানালেন অন্যকথা! শুক্রবার রাতে এপার বাংলার বনেদি বাড়ি এবং কিছু ক্লাবের প্রতিমার বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। সেই সব ক্লাবের ঢাকিরা শনিবার সকাল থেকেই ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের সামনে ভিড় জমিয়েছেন। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা থেকে এসেছেন বিমল দাস, দিলীপ দাস এবং সনাতন বিশ্বাসদের মত আরও বেশ কিছু ঢাকির দল। তাঁদের সঙ্গে কাঁসি বাজানোর জন্য এসেছে বছর দশের শিশু বাসু বিশ্বাস।
সনাতন বাবুর ছেলে বাসু। বাড়িতে রয়েছে তার মা এবং দিদি । ভারত থেকে ফেরার পথে তার জন্য নতুন শাড়ি কিনেছে বলে জানাল বাসু। সে ওপার বাংলায় বসে আছে বাবা-ভাইয়ের পথ চেয়ে।
অন্যান্য বারের মত এবছরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওপার বাংলাথেকে এপার বাংলাযর পুজোয় ঢাক বাজাতে এসেছেন, ঢাকিরা। বিমলদাস (৪৫)। সঙ্গে কাঁসর হাতে ১২বছরের ছেলে সুমন।
বিমল জানালেন, বছরভর চাষাবাদই মূল পেশা তাঁর। পুজোর ক’টা দিন এই ঢাক বাজান। চার দিনে ভারতে এসে বাপ-ছেলে মিলে দশ হাজার টাকা প্রাপ্তি। ভাই রবি দাসও পার্ট টাইমে এ রকম ঢাক বাজান সে এবছর ভারতে আসেনি তাঁদের গ্রামেরই একটি মন্ডপে ডাক পেয়েছিল৷ তবে এবার বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই ফিরতে হচ্ছে দেশে কারণ দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে খবরে শুনেছেন তাঁদের দেশে অনেক পুজোমন্ডপে গন্ডগোল হয়েছে তাই৷
একই দলের সঙ্গী দিলীপ দাস জানান, আমাদের মুখের ছবি তুলবেন না দয়া করে,দু’দেশের দ্বায়িত্বে থাকা পুলিশ ,বিএসএফ এবং বিজিবি জওয়ানেরা আমাদেরকে দয়া করে এই সময় শুধু মাত্র মাযের পুজোর জন্য ঢাক নিয়ে যাতায়াত করতেদেন তবে কোন লিখিত অনুমতি পাইনা ৷ সাথে ঢাক , কাঁসর টাই আমাদের অনুমতি পত্র ৷
বর্ষীয়ান সনাতন বাবু বললেন, বাংলাদেশে এখন ঢাকের কদর নেই বললেই চলে, হাতে গোনা কয়েকটি পুজো তাও এতটাই কম বাজেটের যে পুজো সেরে ঢাকির টাকা দেওয়ার অবস্থায় থাকে না পুজোর উদ্যোগক্তরা৷
বেনাপোলের চন্দ্রকান্ত দাস, গোকুল দাসরা ছ’জনের দল। সবাই তরুণ। এবছর প্রথম ঢাক বাজাতে এসেছে এপার বাংলার পুজোয়। চন্দ্র কান্তদের কথায় দিলীপ বাবুর কথারই সমর্থন মিলল। তাঁদের দলের সবার বাবা-কাকারা ঢাকই বাজান বা বাজাতেন। এখন আর সেই সুযোগ নেই সে দেশে,তাই দুর্গা মায়ের টানে এবার করোনা কে উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারতে এসেছিলেন ঢাক বাজিয়ে কিছু রোজগার সঙ্গে মায়ের দর্শন পেতে৷
গোকুল আরও বলেন, সে দেশে কমবয়সিরা পাঁচ সাত- জনের দল করে তাসাপার্টি বাঁধে সে ,তাসাপার্টির বাজনা নিয়ে যায় অনেকে।তাতে সারা বছর কিছু রোজগার হয় ঠিকই কিন্তু দুর্গা মায়ের সামনে বাবা কাকার শেখানো ঢাক বাজানোর আনন্দনেই ৷ কাঁটাতার পেরতে পেরতে এপার বাংলার দিকে ফিরে তাকিয়ে গোকুল একবার জোর গলায় বলে উঠল ফি বছর তোমার সঙ্গে আবারও ভারতে আসব মা…!