পার্থসারথিনন্দী: পুজোর বাদ্যি বেজে গিয়েছে। তবে মন ভাল নেই বনগাঁ – মছলন্দপুরের ঢাকি পাড়ার ঢাক শিল্পীদের ৷ ঢাকিদের ছাড়া দুর্গাপুজোর কথা ভাবাই যায় না। কিন্তু কোভিড আবহে ঢাক শিল্পের বাজার মন্দা।
পুরাতন বনগাঁর দাস পাড়ায় প্রায় ১০০ টি পরিবার পাঁচ পুরুষ ধরে ঢাক বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। স্বাভাবিকভাবেই দুর্গা পুজো এলে সকলে যেমন আনন্দে মেতে ওঠে, তেমনই দুটো অতিরিক্ত রোজগারের ফলে ঢাকিদের মুখে হাসি ফোটে।
কিন্তু করোনা ভাইরাসমুখের সব হাসি কেড়ে নিয়েছে। নিয়মিত রোজগার নেই। গত দু’বছর ধরে বেশিরভাগ ঢাক শিল্পীই দুর্গা পুজোয় বায়না পাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে সরকারি ভাতার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
দুর্গা পুজোয় প্রতিবারই ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন দাস পাড়ার ঢাকিরা। সঙ্গে উপহারও কম থাকত না। শুধু বাংলাতেই নয়, বাংলার বাইরের পুজোতেও ঢাক বাজানোর বায়না পেতেন কেউ কেউ। ভিন রাজ্যের পুজো আয়োজকরা দূরের ঢাকিদের এখন আর নিয়ে যেতে চাইছেন না। আবার রাজ্যের অনেক পুজো কমিটির বাজেট কাটছাঁট হওয়ায় ঢাকিদের অর্ধেকেরও কম অর্থ দিচ্ছে।
উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুরের বিধান পল্লির বাসিন্দা গোকুলচন্দ্র দাস (ঢাকি) জানান,গ্রামের মহিলাদের ঢাক বাজানো শেখানোর ভাবনাটা তাঁর মাথায় আসে এক মার্কিন মহিলাকে দেখে। সেটা ২০১০ সাল। ঢাকি হিসেবে ততদিনে নাম করে গিয়েছেন গোকুলবাবু। জাকির হোসেনের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়েছিলেন শো করতে। ফেরার আগে ছেলের জন্য স্যাক্সোফোন কিনতে ঢুকেছিলেন সেখানকার একটি দোকানে। এক মহিলাকে নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বিক্রি করতে দেখেন। তখনই গোকুলবাবুর মাথায় গ্রামের মহিলাদের ঢাক বাজানো শেখানোর ভাবনা আসে।
এগার’বছর আগে ছ’জন মহিলাকে ঢাক বাজানো শেখাতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুরের বিধান পল্লির বাসিন্দা গোকুলচন্দ্র দাসের। আর এখন তাঁর মহিলা-শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯০ ছুঁয়েছে! পুরুষ-শিক্ষার্থী আছেন প্রায় ৩০০ জন!
আর এখন পুজো এলেই তাঁর ছাত্রীদের কেউ ঢাক কাঁধে পাড়ি দেন দিল্লি, কেউ অসম, কেউ বা কলকাতা! দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় বছর পঞ্চাশউর্দ্ধ গোকুলবাবুর। তিনি বলেন, ‘‘বেশ লাগে দেখতে। মহিলা-ঢাকিদের কদর বাড়ছে। এটাই তো চেয়েছিলাম। আমেরিকার মহিলা পারলে, আমার গ্রামের মেয়েরা কেন পারবে না? তবে করোনা ভাইরাসের দাপটে দু’ বছর পুজোয় বরাত নেই তেমনভাবে , এবছর কলকাতার সুরুচি ক্লাবে পুজায় ডাক এসেছে ওই টুকুই ! বেশির ভাগ ঢাকিদেরই এবার ঘর বন্দি থাকতে হবে বলে মনে হচ্ছে ’’৷
ঢাকই ছেলেবেলা থেকে গোকুলবাবুর ধ্যানজ্ঞান। বাপ-ঠাকুর্দাও ঢাকি ছিলেন। চার বছর বয়সে গোকুলবাবুর ঢাকে হাতেখড়ি। ছ’বছর বয়সে কাকার কাঁধে চড়ে দুর্গাপুজোয় প্রথম ঢাক বাজান। পড়াশোনা মাধ্যমিক পর্যন্ত। আমেরিকা ছাড়াও তাঁর ঢাকের বোল শুনেছেন বাংলাদেশ, নরওয়ে, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা-সহ নানা দেশের শ্রোতারা। দেশের এমন কোনও বড় শহর নেই, যেখানে তিনি অনুষ্ঠান করেননি। ইংরেজি ‘দ্য ওয়েটিং সিটি’ এবং বাংলায় শতাব্দী রায় পরিচালিত ‘ঢাকি’ ছবিতে তিনি ঢাক বাজিয়েছেন। ‘ঢাকি’তে একটি ছোট চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছেন। বাউল গানও গাইতে পারেন। গোড়ার দিকে ঢাকি হিসেবে সে ভাবে সম্মান না-মেলায় অভিমানে কিছুদিন বাজানো বন্ধ রেখে শুধু গান গাইতেন। তার পরে ফের কাঁধে ঢাক তুলে নেন।
ঢাকের বোল বাণীর উপরে বই লেখার কাজ শুরু করেছেন গোকুল বাবু৷তাঁর তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এবার তাঁর গ্রামেই একটি মিউজিক আকাদেমী খুলবেন ৷ যাতে সেখানে দেশ বিদেশের মানুষ ঢাক বাজানোর প্রকৃত শিক্ষা নিতে পারেন৷
এ পর্যন্ত হলিউডে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে বাজানোটাই নিজের সবচেয়ে বড় সম্মান বলে মনে করেন গোকুলবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘ বেশ কয়েক বছর আগে শো’টা হয়েছিল। হলে ১৮ হাজার শ্রোতা ছিলেন। আমার ঢাক শুনে পণ্ডিতজি বলেছিলেন, ‘আমাদের সব কম্পোজিশন গোকুল ঢাকের তালে ভাসিয়ে নিয়ে গেল’। এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’’
এখনও নিজে বাজান গোকুলবাবু। কিন্তু তাঁর ‘পাখির চোখ’ গ্রামের মহিলাদের ঢাকি হিসেবে তৈরি করা। সারা বছরই তালিম দেন। পুজোর সময় এলে প্রশিক্ষণ-পর্ব দীর্ঘায়িত হয়। বাংলায় এখন ঢাকিদের সুদিন ফিরছে বলে মনে করছেন গোকুলবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘ঢাক এখন আর শুধু দুর্গাপুজোর অনুষঙ্গ নয়। দোকান বা শপিং মলের উদ্বোধনেও ঢাকিদের ডাক পড়ছে। মহিলা-ঢাকিদের কদর তো আরও বেশি।’’
গোকুল বাবু আরও বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে তথ্য সংস্কৃতি দফতরের মাধ্যমে কিছু সংখ্যক ঢাকি শিল্পী কার্ড পাওয়ায় তাঁরা যেমন সরকারি অনুষ্ঠান পাচ্ছেন এবং সঙ্গে মাসিক ভাতাও মিলছে তাঁদের এর পাশাপাশি বহু এলাকায় অনেক ঢাকি রয়েছেন যাঁরা সরকারি ভাবে এই সুযোগ এখনও পাননি তাঁদের কে যদি আমাদের মুখ্যমন্ত্রী একটু দেখতেন তাহলে এই করোনাকালে পুজোর মুখে তাঁদের পরিবারেরও হাসি ফুটতো।
গ্রামের আর পাঁচজন মেয়ে-বউয়ের সঙ্গে গোকুলবাবুর কাছে ঢাক বাজানোর তালিম নিচ্ছেন তাঁর পুত্রবধূ উমা দাস৷ সেই সঙ্গে এই গ্রামেরই ১৪ বছর বয়সের মেয়ে রানী সাহা সহ সঙ্গীতা দাস অনিতা দাসেদের মতো অনেকেই ঢাক বাজানোর তালিম নিচ্ছেন গোকুলবাবুর কাছে৷ রানী সাহার কথায়, ‘‘ গোকুল কাকুর হাতে জাদু আছে। কত সহজে শিখিয়ে দেন। আমিও তো অনেক জায়গায় ইতিমধ্যে বাজিয়েছি।’’ আর গ্রামের সঙ্গীতা দাস , অনিতা দাস, মৌমিতা দাসরা বলছেন, ‘‘কোনও দিন শিল্পী হব ভাবিনি। গোকুলবাবুর জন্যই সেই সম্মান পাচ্ছি। ঘরেও দু’টো পয়সা আসছে।’’
ঢাকিরা জানিয়েছেন সরকারি সাহায্যই এখন তাঁদের একমাত্র ভরসা। রাজ্যের অসংখ্য লোকশিল্পী নিয়মিত সরকারি ভাতা পেলেও বনগাঁ ও মেদিনীপুরের দাস পাড়ার ঢাকিরা শিল্পীর স্বীকৃতি পাননি। ফলে তাঁদের অভাব-অনটন আরও বেড়েছে। তাঁরা সরকারের তরফে ভাতার দাবি করেছেন।