অপরূপ কুমায়ুন (চতুর্থ পর্ব)

দেবাশিস রায়চৌধুরী মানুষ উষ্ণ অথিয়েতায় খুশি হয় জানা ছিল, কাউকে শীতল অভ্যর্থনাতে খুশি হতে দেখিনি।তবে মুন্সিয়ারির পাঁচ ডিগ্রির শীতল অভ্যর্থনায় আমরা কেঁপে গেলাম ঠিকই কিন্তু সবাইকে উৎফুল্ল মনে হল।পঞ্চচুল্লি হোটেলে ঢুকতে হলে বেশ কয়েক ধাপ খাড়াই সিঁড়ি টপকাতে হয়।প্রায় দেড়তলা সমান উচ্চতা। এরপর গ্রাউন্ড ফ্লোর ফার্স্ট ফ্লোর পেরিয়ে সেকেন্ড ফ্লোরে আমাদের ঘর।সেকেন্ড ফ্লোরকেই টপ ফ্লোর বলা যেতে পারে।সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রসস্থ ব্যালকনি যাকে ছাদ বলাই ভালো।ছাদ পেরিয়ে মাঝখানে করিডর রেখে দুপাশে মুখোমুখি কয়েকটা ঘর।তবে আর একটু স্পেশাল ব্যাপার আছে।সিঁড়ির বাঁদিকে ছাদের মাঝে হঠাৎ দ্বীপের মতো একটা ঘর।ঠিক তার সামনে দিয়ে অন্য এক ঘোরানো লোহার সিঁড়ি।সেটা বেয়ে আড়াই প্যাঁচ উঠতে পারলেই কটেজসুলভ আর এক ঘর।হোটেলে ঢুকে যা শোনা গেল তা হল তুমুল হৈহল্লা।অমিয়,শুভঙ্কর, সংস্থিতা, আত্রেয়ীদের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে।বেড়াতে বেরিয়ে আবার কার সাথে ঝামেলা লাগল রে বাবা ! এমনিতে আমাদের দলের লোকজন আর পাঁচটা বাঙালির মতো ঝুটঝামেলা এড়িয়ে চলতে ভালোবাসে।তাহলে হলটা কী ! ছাদ ইস্তক পৌঁছে বোঝা গেল অন্য কারো সঙ্গে নয় নিজেদের মধ্যেই চেঁচামেচিটা হচ্ছে।সকলের আগে পরশ সদলবলে টঙের ঘরের দখল নিয়ে পাহাড় শৃঙ্গ জয়ের মতো সেলিব্রেশন শুরু করে দিয়েছিল।ওদের কথামতো ওটাই হোটেলের সর্বোত্তম ঘর।কারণ জানলার পর্দা সরালেই পঞ্চচুল্লি পর্বত ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না আর ঘরটাও বেশ আভিজাত্যপূর্ণ, ফলে উত্তেজনা স্বাভাবিক। তবে সমস্যা হল মান্তুরা তিনকণ্যাও ঘরটির দাবিদার হয়ে ওঠায়।প্রথমে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তি পালটা যুক্তি,তারপর নারী বনাম পুরুষের চিরন্তন ঝগড়ায় এসে থামল।শেষে মান অভিমান সহ তিনকণ্যার, ‘যা,তোদের ছেড়ে দিলাম’ গোছের প্রস্থান।

ওদের এই ঝগড়া আমার ছেলেবেলার তুতো ভাইবোনদের কথা মনে পড়িয়ে দিল।এই কারন অকারণে ঝগড়া মারপিট তো কিছক্ষণ পরেই আবার গলায় গলায় ভাব।এরাও তাই রাত কাটলেই সব রাগ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে।এইসব ছোটোখাটো খুনসুটি আছে বলে ট্যুর আরও সুন্দর হয়ে ওঠে।

ঘরে লাগেজ রেখে ছাদে এসে দাঁড়ালাম। আর কি বলব মেজাজ শরীফ হয়ে গেল মাশাল্লাহ ! দূর পাহাড়িয়াকে ছাঁওমে সে এক আজীবসা তসবীর আসমান জুড়ে ছড়িয়ে আছে।ক্যায়সা উও তসবীর? ছাদে দাঁড়িয়ে যে দিকে তাকাই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। চারিদিকে পাহাড়, যেন এক উপত্যকায় দাঁড়িয়ে চেয়ে আছি অনন্তের দিকে।পূর্ণিমা পেরিয়েছে সবে দুইদিন তাই আজও পূর্ণ চাঁদ, তবে উঠছে একটু দেরী করে।পঞ্চচুল্লির মাথায় চৌদনী কা চাঁদ রফি সাহাবকে ইয়াদ করিয়ে দিচ্ছে।আকাশে হালকা মেঘ আছে তাই চাঁদের আলো সামান্য ঘোলাটে।সেই আলোয় সামনে পঞ্চচুল্লি মহান গাম্ভীর্য নিয়ে জেগে আছে।বরফে ঢাকা পাঁচ পাহাড়ের চূড়ায় তরল রূপো চিকচিক করে উঠছে।আর তিন দিকের পাহাড়ে বিন্দু বিন্দু আলো জন বসতির অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।ছাদে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না।বরফ পাহাড় পেরিয়ে আসা হাওয়া কাঁপন ধরিয়ে দেয়।বিশ্বাস হয় না পাহাড়ের এত কাছে আছি,যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলা যাবে।এই অপার্থিব মুহূর্তে চোখ ভিজে ওঠে।কেন জানি না মনে পড়ে এক বালকের কথা যে,দইওয়ালার সাথে যেতে চেয়েছিল পাঁচমুড়ো পাহাড়ের তলার এক গ্রামে।যেখানে শামলী নামের এক নদী আছে।তার এসব দেখা হয়নি।এই বিস্তীর্ন পর্বতশ্রেণীর চৌহদ্দির মধ্যেও আমার কানে ভেসে এল এক করুণ বালকের হৃদয়ের আর্তি,”দই, দই, দই, ভালো দই! সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায় শামলী নদীর ধারে গয়লাদের বাড়ির দই। তারা ভোরের বেলায় গাছের তলায় গোরু দাঁড় করিয়ে দুধ দোয়, সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা দই পাতে, সেই দই। দই, দই, দই―ই, ভালো দই! “আমরা তাকে ভুলে গেছি কিন্তু সুধা তাকে আজও ভোলেনি।

কিছু বাস্তব,কিছু স্বপ্ন কিছু বিভ্রম কাটিয়ে দোতলায় নেমে দেখি, সেখানে জমাটি আড্ডা বসেছে।গরম পকোড়া আর কফির ঢালাও ব্যবস্থা।বাইরে কনকনে ঠান্ডা সিঁড়ির পাশ থেকে হঠাৎ হঠাৎ ভিতরের হালহকিকত জেনে নেওয়ার জন্য ঢুকে পড়ছে।তবে এতে আড্ডার মেজাজ টসকাচ্ছে না বরং জোশ আরও বাড়ছে।রাতও বাড়ছে।হারুদার কিচেন থেকে খবর এল ডিনার রেডি।গরম ভাত,চিকেন খেয়ে বিছানায় আশ্রয় নিই।এই প্রথম সকালে উঠেই হোটেল ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার নেই।কাল আমরা মুন্সিয়ারি থাকছি।

সকালে উঠেই ছাদে যাই।তারপর বিস্ময়াহত বলতে যা বোঝায় তাই হয়ে যাই।চোখের সামনে যা দেখছি তা বিশ্বাস হয় না।এই কি স্বর্গলোক! পৌরানিক কাহিনি অনুযায়ী অবশ্য স্বর্গারোহণ পর্ব এখান থেকেই শুরু।আকাশে এখনও রঙ লাগেনি।কাল রাতে শুধু পঞ্চচুল্লি চোখে পড়েছিল এখন তার দুপাশে নাম না জানা আরও কিছু পর্বতশ্রেণী দৃশ্যমান।কাছাছি কোনও মন্দির থেকে ভজনের সুর ভেসে আসছে।আমাদের হোটেলের উল্টো দিকে একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেখানে বারান্দায় ক্র‍্যাচ হাতে এক জন উর্ধমুখী হয়ে আবৃত্তি করে চলেছেন, ” ওঁ নমঃ জবাকুসুম-সংঙ্কাশং, কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং ।

ধ্বান্তারিং সর্ব্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরং ।” ঈশ্বর উপাসক বলে আমার কোন খ্যাতি নেই বরং অর্চনা না করার অখ্যাতি প্রবল।তবুও এই মুহূর্তে ছোটোবেলায় শেখা ওই শ্লোকের বাংলা অর্থ আপনা আপনি মনে পড়ে গেল,”জবাফুলের ন্যায় রক্তবর্ণ,কশ্যপের পুত্র, অতিশয় দীপ্তশালী, তমোনাশী, সর্ব্বপাপ নাশকারী দিবাকরকে প্রণাম করি ।”

আকাশ আস্তে আস্তে রঙ লাগছে।

ছবি তুলেছেন সুপর্ণা রায় চৌধুরী,

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here