আমি যে খুব ভালো গল্প-উপন্যাস কবিতা পাঠক এমনটি নয়৷ এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমার ভালো লাগে পরিবেশ বিষয়ক নানা ধরনের প্রবন্ধ, দেশি-বিদেশি পরিবেশ সংক্রান্ত নানা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে, সঙ্গে পৃথিবীর মুক্তমনা মানুষের মানবিক সম্পর্কের উপর আলোচিত নানা ভাবনা৷ তবে হ্যাঁ, আমার নিকটজন, প্রিয়জন, ধুলোখেলা-বন্ধু স্বজনদের যেকোনো ভাবনাচিন্তা আমি জানতে চাই যেকোনো ভাবে, হয়তো মাঝেমধ্যে তাদের সাথে বিবাদ ও নির্বিবাদ আড্ডা বা তাদের গোপনে লিখিত কোন ভাবনা চিন্তার সাথে।
আমি আনন্দঘন এবং আবেগময় এ কারণে যে আমার ধুলোখেলা দুই বন্ধু, যথা অর্ঘ্য মন্ডল এবং কৃষ্ণেন্দু পালিতের সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি গ্রন্থের নিবিড় পাঠ। এই আলোচনায় আমি কৃষ্ণেন্দুর প্রকাশিত ‘পাঁচশো হাজারের নোট’ গল্পগ্রন্থ খানি খুব খুশিতে পড়ে ফেললাম৷ গ্রন্থে দশটি গল্প রয়েছে৷ লেখক পেশায় শিক্ষক তাই প্রথম গল্পে ‘দশ টাকার নোট’ -এ দেখাতে পেরেছে সমাজের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের করুণ মুখ৷ লেখক-শিক্ষক এই গল্পে শিক্ষার্থীর বই পড়ার বাইরের জীবন কীভাবে ক্লাস রুমে ঢুকে পড়ে এবং বন্ধুদের দ্বারা অপমানের ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে হারিয়ে যাওয়া দশ টাকার নোট ফিরে পেয়ে দুপুরের ঘুগনি রুটি খাওয়ার তৃপ্তির দৃশ্য আমার চোখে জল এনেছে৷ ‘বনসাই’ গল্পের বিষয়ও শিক্ষার্থী৷ একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, তার মায়ের অসম্ভব উচ্চাকাঙ্ক্ষায় পড়ে কিভাবে কৈশোর এবং যৌবনের প্রারম্ভ নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে, তার গল্প দক্ষতার সাথে বুনন করেছে কৃষ্ণেন্দু। ‘কানসোনা প্রাথমিক বিদ্যালয়’ও শিক্ষা কেন্দ্রিক গল্প৷ নতুন এস.আই ম্যাডামের আগমন ও একজন তথাকথিত অশিক্ষিত অভিভাবিকার উপস্থিতি একটি বিদ্যালয়ের পরিবেশ কিভাবে বদলে দেয় তার উৎকৃষ্ট এবং দমবন্ধ কথোপকথন গল্পকে সসম্মানে এগিয়ে নিয়ে যায়৷ আমার মনে হয়েছে কৃষ্ণেন্দু ছোট বেলায় দারিদ্র দেখেছে, দারিদ্র মেখে বড় হয়েছে বলে ওর কলম এই ধরনের সমাজ নিয়ে বেশি চলৎশক্তি পায়৷ হুড়হুড় করে লিখে ফেলে সমাজের গোপন কান্না, সমস্যা আর অসুখের পূর্বাভাস৷
আমাদের আর এক বাল্যবন্ধুর নাম দিয়ে, তাকে গল্পের নায়ক করে, গল্পের শিরোনাম ‘সব পাঁচশো হাজারের নোট’ গল্পটি লিখেছে কৃষ্ণেন্দু৷ এই গল্পে অসম্ভব অতৃপ্ত সমাজ ব্যবস্থা, দুর্নীতি, অসাম্য, দুরাচারী, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মুখে সজোরে দুই লাথি কষিয়ে দিয়েছে। গল্পের নায়ক কার্তিক টিউশনির সামান্য টাকায় যে একক অতি সরল দিনযাপন করে, সমাজ তাকে সন্দেহ করে নোটবন্দির সময়। যখন বহু মানুষ গোপনে পাঁচশো হাজার -এর নোটগুলো নামে বেনামে আইন সিদ্ধ করে নিচ্ছিল, সেই সময় কার্তিক যেখানেই যাচ্ছে তাকে শুনতে হচ্ছে, আপনার কত ছিল? এই নোটবন্দির দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেখা ব্যর্থ ছড়া যখন গভীর রাতে গোপনে পুড়িয়ে দিচ্ছে আত্মগ্লানিতে ভোগা একজন সরল সাদাসিদে মানুষ, তখন পাশের বাড়ির মানসদা চিৎকার করে বলছে, রাত দুপুরে এসব কি হচ্ছে কার্তিক?
কার্তিক উত্তর দেয়, পোড়াচ্ছি৷
-কেন ?
কার্তিক: না পুড়িয়ে উপায় নেই তাই। কার্তিক পোড়াচ্ছে ব্যর্থ ছড়া, জীবনের ব্যর্থতা৷ সমাজ ভাবছে কার্তিকের কালো টাকা পুড়ে যাচ্ছে। এই গল্প পড়ে আমি আনন্দে কেঁদে ফেলেছি৷ মনে হচ্ছে লম্বু কৃষ্ণেন্দুকে একটা চুমু দিই৷ আমরা জানি কৃষ্ণেন্দুর কাটাকুটি, ফ্রেশ করা এবং ভাবতে ভাবতে হয়ে ওঠা একজন কথাকার৷ লেখার ক্ষেত্রে পারিবারিক ঐতিহ্য নেই, আভিজাত্য নেই, কিন্তু পরিশ্রম পরিশ্রম আর পরিশ্রম কৃষ্ণেন্দুকে সমাজমনস্ক কথাকার হিসাবে গড়ে তুলেছে৷ গ্রন্থের অন্য গল্পগুলোও যথেষ্ট সুন্দর, বাস্তবধর্মী, এককথায় সমাজবীক্ষণ৷ এই গ্রন্থের আগে তার আরও পাঁচটি গ্রন্থ আছে৷ সেগুলো সব পড়েছি৷ বোঝা যায় এই গ্রন্থটি হবে উন্নততর৷ এমন একটি বই আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য তোকে আর ধন্যবাদ জানাবো না বরং বইটি না পেলে এবং না পড়লে বন্ধু জীবনের এক মহাপাতক হয়ে থাকতাম৷ এত পরিশ্রম এবং মনের জন্য অন্তহীন শুভেচ্ছা৷ শুভেচ্ছা অভিযান পাবলিশার্সকে৷
পাঁচশো হাজারের নোট
কৃষ্ণেন্দু পালিত
অভিযান পাবলিশার্স
মূল্য : ১৭৫ টাকা