দীপক বিশ্বাস ঃ
কোনও বই পড়ার পর তার রেশ যদি মনের মাঝে গুঞ্জরিত হয়, তবে বুঝতে হবে সে বই পাঠকের মনে সাড়া জাগিয়েছে। পাঠককে ভাবিয়েছে — তার মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অনুকূল স্বাদ তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে। – এমন প্রতিক্রিয়া যে লেখার মধ্যে সেই লেখাই সার্থক লেখা; সেই লেখকই প্রকৃত নির্মাতা।
এমন একজন নির্মাতার খোঁজ পেয়েছি ” অল্প কথার গল্প ” নামক ক্ষুদ্র ও অণুগল্প সংগ্রহের লেখক “কৃষ্ণেন্দু পালিত” – এর মধ্যে। বনগাঁর “সীমান্ত বাংলা প্রকাশনী”কে ধন্যবাদ এমন উৎকৃষ্ট গল্প সংকলন প্রকাশ করার জন্য। বইয়ে মোট গল্প সংখ্যা চৌত্রিশ। কিন্তু তাতেই গল্পকার জাত চিনিয়ে দিয়েছেন। সমসাময়িক রূঢ় বাস্তবতা গল্পের মর্মে নিহিত। এ গ্রন্থের বেশির ভাগ গল্প চলতে চলতে একেবারে শেষ লাইনে তার সমস্ত সুধা বর্ষণ করে। সমাপ্তি অনেকটা বনফুলের গল্পের ধাঁচ —- কিন্তু ধাঁচ এক হলেও কাচ নয় — হিরে — খাঁটি হিরে।
হাঁড়িতে চাল ফুটেছে কি না তা জানতে দু-চারটে চাল টিপে দেখলেই চলে, পুরো হাঁড়ি ওলট-পালট করার দরকার হয় না ; তেমনি দু চারটে গল্প নিয়ে আলোচনা করলেই বোঝা যাবে এর স্বাদ,গন্ধ।
গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘ রং-বাজি’। পৃথিবী রঙের কারখানা। সে কারখানা থেকে সঠিক সময়ে সঠিক রং বেছে নিয়ে প্রয়োগ করতে পারলে জীবন রঙিন হয়, আর না পারলে সারা জীবন সে রং রংবাজি করে যায়। স্ত্রী চায় স্বামীর জীবনও রঙিন হোক। তাই মাথা যন্ত্রণায় আগে লাল ওষুধ খাক, পরে সবুজ। এই রং মেলাতে গিয়ে স্বামীর জীবনের সব রং শুকিয়ে যায়। তবু স্ত্রীকে মনে করেঃ
” যম আর বউয়ের কোনও পার্থক্য নেই। ”
অবশেষে ওষুধের রং মিললেও বউয়ের মনে তখন অন্য রং জায়গা করে নিয়েছে। তাই কথককে আবার পথে নামতে হয় —
” আমি আবার ডাক্তার খুঁজতে বেরিয়েছি। ”
এ এক মানসিক টানাপোড়েনের গল্প। আমরা জীবনের প্রতিক্ষণে সবাই সবার সঙ্গে রঙ মিলাতে ব্যস্ত যাতে জীবন মসৃণ হয়। সেটা ওষুধের রূপকে লেখক চমৎকার তুলে ধরেছেন।
বর্তমান বাংলার রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ‘ পরিবর্তন ‘। পরিবর্তন সবসময় উৎকর্ষতার পথে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তাতে ভড়ং থাকা উচিত নয়। ‘খোকন প্রামাণিক’ এলাকার ত্রাস —
“খুন, ধর্ষণ, ভোটের সময় রিগিং কী করেনি জীবনে! ”
সেই খোকন প্রামাণিক হঠাৎ নিজের রাজনৈতিক দলের বিপর্যয় দেখে ‘সাধু’ হয়ে যায়। সেটা যে মনে মনে একটা কুটিল খেলা তা মুহূর্তেই বোঝা যায়। পদবি তার ‘ প্রামাণিক’ মানে ‘প্রমাণসিদ্ধ’ — বিশ্বাসযোগ্য। ক্ষণিকের জন্য তার বদল দেখে বিশ্বাস জন্মেছিল কথকের মনে। কিন্তু তা যে শরতের মেঘ? দাড়ি কাটাতে আসা খরিদ্দারের কাছে ভোট ভিক্ষা করে। খরিদ্দার আমতা আমতা করলে খোকন আপন মূর্তি ধরে। খুরটা শ্বাসনালীর ওপর চেপে —
” শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় এবার সরাসরি আদেশ করে, ভোটটা আমাকেই দিবি।”
এসব খোকন প্রামাণিকেরা গণতন্ত্র বোঝে না — বোঝে ক্ষমতা ধরে রাখার খেলা, তাই ক্ষণে ক্ষণে জামা বদলানোর মত দল বদলায়। সাম্প্রতিক বাংলার যা অবস্থা তাতে সবাই-ই খোকন প্রামাণিক। ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে খোকনেরা ঝাড়ে-বংশে। লেখকের কলমের ছোঁয়ায় রক্ত- মাংসের খোকন অনবদ্য।
বিষ্ণুর দশ অবতারের কথা পুরাণে পাই, একাদশ অবতার বলে কাউকে ধরা হয়নি। যদি পুরাণকারেরা আরও একটু কল্পদৃষ্টিকে প্রসারিত করতেন, তো আমি নিশ্চিত ‘একাদশ অবতার’ হিসাবে একালের ‘রাজনৈতিক নেতা’দের নির্দেশ করতেন। অসীম তাদের পাওয়ার, অনন্ত ইচ্ছে তা পাওয়ার। ধরাকে যে কোনও সময় সরা বানিয়ে তারা হাঁড়ি, মালসার মুখে বসিয়ে দিতে পারেন। এমনই এক ন্যাতা, থুড়ি ন্যাতার ভাই জগন্নাথ। জগতের ত্রাণকর্তা!
অনেক আগে আমাদের দেশকে “কি বিচিত্র এই দেশ “! বলা হয়েছে। সত্যি তাই । ট্রেনে – বাসে উঠলে আমরা বিচিত্র দেশের কল্যাণে নানা অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড়াই। বিচিত্র চরিত্রের মানুষ যে তখন চারিদিকে? তাদের মধ্যে সবচেয়ে দেমাগ ও ক্ষমতার আস্ফালন যাদের, তারা হলেন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী। বলে রাখা ভাল এসব নেতা-নেত্রী বনগাঁয়ে শিয়াল রাজা আরকি! তবে তাদের হাত আবার চারটে – ডান,বাম, অজু ও রাজনৈতিক পরিচয়ের হাত। এরা সব ব্রহ্মারই মানসপুত্র। এদের পিছনে নাকি বুদ্ধিজীবী ” কুত্তার মত ফ্যাঁ ফ্যাঁ করে ঘোরে। ” অথচ ‘জগন্নাথের হাত’- এ এদের পরিচয় —
” কুসুমপুর ৩ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের মেম্বার বলরাম মালাকারের ছোট ভাই।”
যার নিজের পরিচয় শূন্য। তবু এদের হাত লঙ্কা পোড়ানো হনুর লেজের মত লম্বা —
” দাদা মেম্বার, প্রধানের ডান হাত।প্রধানের সঙ্গে এমএলএ-র ভালো সম্পর্ক — শুনেছি এমএলএ-র সঙ্গে আবগারি মন্ত্রীর আবার ভালো রিলেশন — আবগারি মন্ত্রী তো মুখ্যমন্ত্রীর খুব কাছের মানুষ — মুখ্যমন্ত্রী আবার কোয়ালিশন সরকারে আছে। চাইলে তিনি প্রধানমন্ত্রীরও হেল্প নিতে পারেন। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তো আমেরিকার অর্থনীতি ফলো করছেন। আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেন। প্রয়োজনে উনি ওবামার সাহায্যও পাবেন। চাই কি ন্যাটোর সৈন্য পাঠিয়ে দেবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।মানে জগন্নাথ টু ওবামা, হাতটা নেহাত কম লম্বা নয়।”— এমন লম্বা হাত যার, তিনি আর যাই হন ‘মানুষ ‘ হতে পারেন না। গল্পের একেবারে শেষে নীলুদা উচ্চগ্রামে জানান উনি যেটা নন তা হল – ‘ মানুষ ‘।
কি অসাধারণ লেখা! একেবারে চলতে ফিরতে চোখের সামনের ঘটনা সরস ভাবে তুলে ধরেছেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। এ এক অনন্য কৃতিত্ব।
ভারতের রাজনীতি করতে গেলে শিক্ষিত হতে হয় না — কোনও মতে চোখ ফোটার মত পড়াশোনা জানলেই যথেষ্ট। এমন বিষবাষ্প বড়দের মনে তো আছেই, নাবালকের মনেও যে গেঁথে গেছে তা ‘ সহজ অংক ‘ না পড়লে ভাবনাতেই আসবে না। ক্লাস এইটের ছেলের সহজ ভাবনা—
” বাবা বলেছে, পটলবাবু ফাইভ পাস। ভোটে জিতে কী যেন একটা হয়েছে, এখন দেশ চালাচ্ছে —”
” তাতে তোর কি? ” — শিক্ষকমশাই জানতে চান। ছাত্র বলে —
” আমিও রাজনীতি করব। ” ভাবা যায় ! এমন ভাবনা ওইটুকু বাচ্চার হৃদয়ে গেঁথে গেছে!
‘ পরমার্থ ‘ লাভ করা এ সংসারে বহু কঠিন! সংসার যন্ত্র, সংসার স্বার্থ এ পথে স্ত্রীধনের মতো বাধা দেয়। পরমেশের জীবনেও এমন বাধা আসে স্ত্রীর কাছ থেকে। বাউল দরবেশের সাথে প্রাণ খুলে দুটো কথাও বলা যায় না। কিন্তু দরবেশের গান হৃদয়ে অনুরণিত হয় —
” সবুর মেওয়া রইল মাথায়
যাইবো এবার যেথায় সেথায়
রোদ বৃষ্টি আশির্বাদী
আমার মাথায় ঢেলো
তুমি এমন খেলা খেল……”
বইটা পড়ার পর নিজেকে ‘পরমেশ’ মনে হল, বাউল-দরবেশের গান যার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল; ঠিক তেমনই, বইয়ের প্রায় অর্ধেক গল্পের রেশ হৃদয়তন্ত্রীতে একতারার সুর তুলছিল। অনেক দিন পর অন্য রকম গল্প পড়লাম—– অন্যের গল্প পড়লাম, যাঁর সাথে অন্যদের মিলাতে পারছিলাম না সহজে। মিলাতে না পারার কারণ এ গল্পের স্বাতন্ত্র্যতা ; অনন্যতা। এ গল্পগুলো অন্য গল্পের চেয়ে স্বাদে,গন্ধে আলাদা। আলাদা হওয়ার জন্য সহজে চোখে পড়ে — বসন্তের বহু ফুলের মধ্যে কৃষ্ণচূড়া আলো ছড়ায় । বনফুলের গল্প কিংবা ও’ হেনরীর গল্পের সমাপ্তির মত কৃষ্ণেন্দু পালিতের গল্পগুলোর সমাপ্তির ঢংয়ে কিছুটা মিল আছে সত্যি; কিন্তু বনফুল কিংবা ও’ হেনরীর গল্প শেষে বৈপরীত্যের সংঘটন আছে, একটা চাবুক হাঁকড়ানো সমাপ্তি আছে। পরিবর্তে কৃষ্ণেন্দুবাবুর হাতে আছে খেপলা জালের দড়ি, সম্পূর্ণ গল্পে বুনে আসা মাছকে হঠাৎ ছোঁ মেরে জাল ফেলে মূল রহস্যকে তালুবন্দী করার রীতি গল্পে বিধৃত। অনেকটা জ্বাল দেওয়া দুধের সরটাকে হঠাৎ চামচ দিয়ে তুলে নিয়ে জিভের স্বাদকোরকের ওপর বসিয়ে দেওয়া। একটু পরেই যে জিভ নড়েচড়ে বলে উঠবে ” আহা ” !