দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ এবছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারীর পরিচয় দিতে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভানেত্রীর ‘মুসলিম কন্যা’ মন্তব্য নিয়ে নিন্দার ঝড় শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। উচ্চমাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের বৈঠকে পরীক্ষার্থীকে কয়েকবার ‘মুসলিম কন্যা’ বলে সম্বোধন করেছেন সভানেত্রী মহুয়া দাস। ওই মেয়েটির জায়গায় কোনও হিন্দু পরীক্ষার্থী থাকলে কী তাঁকে ‘হিন্দু কন্যা’ বলে সম্বোধন করা হত, এই প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।তাতে আহত রাজ্যের নাগরিকদের একাংশ।
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন’, কাজী নজরুলের বহুচর্চিত গানের লাইনই ফের ঘুরে-শোনা যাচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের আবহে। প্রশ্ন উঠছে, পরীক্ষায় যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে, তার নাম উচ্চারণেরও আগে কেন বড় হয়ে উঠবে তার ‘মুসলিম’ পরিচয়টি?
সেইসঙ্গে অনেকেই পর্ষদের সাংবাদিক বৈঠকের ভিডিও টুইট করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ভিডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘এককভাবে পেয়েছে একটি মুসলিম কন্যা, মুসলিম, মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে একজন মুসলিম লেডি, গার্ল, তিনি এককভাবে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন।’
ভিডিও–সহ বিজেপির মিডিয়া ইনচার্জ সপ্তর্ষি চৌধুরির টুইট, ‘ভাগ্যিস বেগম রোকেয়া বাঙালি ছিলেন…। কোনও সরকার যে এই ভাবে ধর্ম উল্লেখ করে ফল ঘোষণা করে জানা ছিল না।’ টুইটে হ্যাশট্যাগ ‘এগিয়েবাংলা’ দিয়েছেন তিনি। একইভাবে বিজেপির মহিলা মোর্চার জাতীয় সভাপতি মালতী রাভা রায়ও টুইটে ভিডিওটি শেয়ার করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘পড়ুয়াদের পরিচয় তাঁর ধর্মে নয়। কেন বার বার তাঁর ধর্মীয় পরিচয় বলা হল, বোঝা গেল না!’
মুর্শিদাবাদের কান্দির মেয়ে রুমানা সুলতানার সাফল্য কোনও ‘অঘটন’ নয় বলে সরব প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীও। তিনি সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘মুসলিম মহিলা প্রথম হয়েছে’, যারা বার বার বলছে, তাদের এত অবাক কেন হতে হচ্ছে! ছাত্রীর নাম দেখে সে কোন ধর্মের বোঝানোর দায়িত্ব না-নিলে খুশি হব।’ অনেকেই লিখেছেন, মুসলিম পড়ুয়ারা এর আগেও রাজ্যে মেধা তালিকায় প্রথম সারিতে এসেছেন। তখন কিন্তু ধর্মের উল্লেখ দেখা যায়নি। এর ফলে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক বিভাজন বাংলাকে বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যাবে, মত তাঁদের।
মুর্শিদাবাদের অতনু প্রজ্ঞান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নিজের জেলার মেয়ে প্রথম হলে ভালই লাগে। আমাদের মুর্শিদাবাদের এই মেয়েটিই হল রুমানা সুলতানা, যে উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হয়েছে। গর্ব হচ্ছে। আরো ভালো লাগছে যখন দেখলাম মেয়েটি আমার মামাবাড়ি কান্দির। রুমানা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ঘরের মেয়ে। রেজাল্ট ঘোষণার সময় একটি বাক্যে তিন চার বার ‘মুসলিম মেয়ে’ বলে চিৎকারের কিছু ছিল না। মাদ্রাসায় পড়া অতি দরিদ্র মুসলিম ঘরের কেউ হলে তবুও মানা যেত, ইন্সপিরেশন হিসেবে অন্যদের সামনে। কিন্তু সম্পন্ন শিক্ষিত মুসলিম ঘরের ছেলে–মেয়েরা অনেকেই ভালো রেজাল্ট তো করেই। আল আমিন মিশনের ছেলে মেয়েরা দারুণ সব রেজাল্ট করে জয়েন্টেও। এই মেয়েটি যেহেতু মুসলিম, তাই ফার্স্ট হয়েছে বলে ওর মুসলিম পরিচয় বার বার সামনে এনে অত্যন্ত মেলোড্রামা করল সরকারি প্রতিনিধি। রাজনৈতিকভাবে জলঘোলা করল। এবং মেয়েটিকে অপমানও করল।’
মুর্শিদাবাদেরই রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতির সভানেত্রী খাদিজা বানু বলেন যে, ‘আমরা আগে ভারতীয়। পরে হিন্দু–মুসলিম–খ্রিস্টান। ওই ছাত্রীর ধর্মীয় পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তবে এই মেয়েটি যদি তফশিলি বা আদিবাসি পরিবারের হত এবং তাঁর সেই পরিচয়কে সামনে আনা হতো তাহলে হয়ত এত বিতর্ক হত না। সমাজের এই দিকটিও ভেবে দেখার বিষয়।’
পর্যদ সভানেত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে তাঁর ওই বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, যেহেতু এবছর কোনও গ্রেডেশন লিস্ট প্রকাশ করা হয়নি, তাই কৃতীদের নাম সাংবাদিক বৈঠকে বলা যায়নি। যদি সংশ্লিষ্ট ছাত্রীর নাম বলার সুযোগ থাকত, তাহলে হয়তো ধর্মীয় পরিচয় বলার প্রয়োজন হত না। ধর্মীয় পরিচয়টি বলতে হয়েছে কারণ, সংসদের ইতিহাসের এটি একটি রেকর্ড। এর আগে কোনও মুসলিম ছাত্রী উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হয়নি। সংবাদমাধ্যমকে সেটা জানাতে গিয়েই ‘মুসলিম কন্যা’ বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
তবে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ সূত্রে বলা হয়েছে, জেলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি মেয়ে কতটা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে, তা বোঝাতেই ‘মুসলিম’ শব্দটি বলা হয়েছে। নানা ক্ষেত্রেই তো কিছু বোঝাতে সংখ্যালঘু শব্দটি ব্যবহার হয়। এখানেও সে-ভাবেই বলা হয়েছে।