দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনে কাজ হল কতটা, এতদিন সেই অপেক্ষাই চলছিল। এবার সেই রিপোর্টই সামনে আনল ‘দ্য ল্যানসেট’ মেডিক্যাল জার্নাল।

অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নিরাপদ। প্রতিষেধক প্রয়োগে শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। প্রথম ট্রায়াল সফল। সোমবার রিপোর্ট দিয়ে জানালেন গবেষকরা। প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালে ১০৭৭ জনের শরীরে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রয়োগ করা হয় এই ভ্যাকসিন। রিপোর্টে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনে প্রয়োগে রোগীদের শরীরে তৈরি হচ্ছে অ্যান্টিবডি এবং শ্বেত রক্তকণিকা। যা করোনা জীবাণু প্রতিরোধে সক্ষম, বলছেন অক্সফোর্ডের গবেষকরা। জানানো হচ্ছে, প্রথম ট্রায়ালের ফল আশা দেখাচ্ছে। তবে এখনই এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে, এই ভ্যাকসিনেই করোনার বিনাশ সম্ভব।

আরও বড় পরীক্ষামূলক ট্রায়ালের পরই সব পরিষ্কার হবে, জানাচ্ছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যান্ড্রু পোলার্ড। 
গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন। আগেই জানা গিয়েছিল, এই ভ্যাকসিন শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে জীবাণুর যম ‘‌টি–সেল’ গঠনে সাহায্য করবে। অন্য বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে দেখা গেছে, প্রতিষেধক দু–তিন মাসের মাথায় শক্তিহীন হয়ে পড়ছে। সেখানে অক্সফোর্ডের এই ভ্যাকসিন শরীরে অতিরিক্ত টি–সেল তৈরি করতে পারলে লড়াইটা আরও বেশ কয়েকদিন জারি রাখা সম্ভব, জানিয়েছেন গবেষকরা। ‌  

প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ–সুইডিশ বায়োটেকনোলজি ফার্ম অ্যাস্ট্রজেনেকার সঙ্গে যৌথ প্রয়াসে ডিএনএ ভেক্টর ভ্যাকসিন বানিয়েছে অক্সফোর্ডের ভাইরোলজিস্ট সারা গিলবার্টের টিম। প্রতিষেধকের নাম দেওয়া হয়েছে ‘‌AZD1222’‌ এই ভ্যাকসিন ট্রায়ালের দায়িত্বে ছিলেন ভাইরোলজিস্ট সারা গিলবার্ট, অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড, টেরেসা লাম্বে, ডক্টর স্যান্ডি ডগলাস ও অধ্যাপক অ্যাড্রিয়ান হিল এবং জেন্নার ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। 

ল্যানসেট জার্নাল জানিয়েছে, ১০৭৭ জন স্বেচ্ছাসেবককে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল। প্রায় প্রত্যেকের শরীরেই টি-কোষ (T-Cell)সক্রিয় হয়েছে। পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়েছে। প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালের রিপোর্ট দেখে ইতিমধ্যেই দশ কোটি ভ্যাকসিনের অর্ডার দিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার।

কীভাবে তৈরি হয়েছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন? কীভাবে সক্রিয় করছে টি-কোষকে?

জেন্নার ইউনিভার্সিটির গবেষকদের সাহায্যে ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) টেকনোলজি ব্যবহার করে ভেক্টর ভ্যাকসিন ChAdOx1 nCoV-19 ক্যানডিডেট ডিজাইন করেছে অক্সফোর্ডের ভাইরোলজিস্ট সারা গিলবার্টের টিম। এই গবেষণায় রয়েছেন অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড, টেরেসা লাম্বে, ডক্টর স্যান্ডি ডগলাস ও অধ্যাপক অ্যাড্রিয়ান হিল। পরে অক্সফোর্ডের সঙ্গে এই ভ্যাকসিন গবেষণায় যুক্ত হয় ব্রিটিশ-সুইডিশ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাস্ট্রজেনেকা। সারা গিলবার্টের টিম জানিয়েছে, অ্যাডেনোভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে তৈরি এই ভেক্টর ভ্যাকসিন মানবদেহের বি-কোষ (B-Cell) ও টি-কোষকে (T-Cell) উদ্দীপিত করে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করবে। যেহেতু নিষ্ক্রিয় অ্যাডেনোভাইরাসকে ভেক্টর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তাই এই ভ্যাকসিনের কোনও ‘অ্যাডভার্স এফেক্ট’দেখা যাবে না মানুষের শরীরে।

গবেষক অ্যান্ড্রু পোলার্ড জানিয়েছেন, এই টি-কোষ হল শরীরের রোগ প্রতিরোধের মূল বর্ম। বেশিরভাগ ভ্যাকসিনই অ্যান্টিবডি তৈরির প্রক্রিয়াকেও যেমন সক্রিয় করে তেমনই টি-কোষকে সক্রিয় করে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ভ্যাকসিনে কাজ হলে ইঞ্জেকশন দেওয়ার ১৪ দিনের মাথায় টি-কোষ সক্রিয় হয়ে ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তুলতে শুরু করে। বি-কোষ সক্রিয় হয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি করে ২৮ দিনের মাথায়। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনও তাই করেছে। ৯০ শতাংশ মানুষের শরীরে এক ডোজেই অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে। বাকি ১০ শতাংশকে দুটি ডোজ দেওয়া হয়েছিল। তাদের শরীরেও পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে।

সামান্য কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষক পোলার্ড। তবে মারাত্মক কিছু নয়। ভ্যাকসিন দেওয়ার একদম পর পরই ৭০% স্বেচ্ছাসেবকের হালকা জ্বর ও মাথাব্যথা হয়। তবে সেটা কিছুদিনের মধ্যেই সেরে যায়।

অক্সফোর্ডের টিকার ট্রায়াল শুরু হয়েছিল এপ্রিল থেকেই। প্রথম দু’জনের শরীরে ইনজেক্ট করা হয়েছিল ভ্যাকসিন। তাঁদের মধ্যে একজন মহিলা বিজ্ঞানী। নাম এলিসা গ্রানাটো।  তারপর প্রথম পর্যায়ে কম সংখ্যক মানুষের শরীরে টিকার পরীক্ষা করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে হাজারের বেশি জনকে টিকা দেওয়া হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চালাচ্ছিল অক্সফোর্ড। এই পর্যায়ের ট্রায়ালেও টিকার প্রভাব সন্তোষজনক বলেই দাবি করা হয়েছে। যদিও এখনও অবধি শুধু প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালের রিপোর্টই সামনে এসেছে।

ব্রিটেনে অক্সফোর্ডের টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলার সময়েই ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে এই টিকার ট্রায়াল শুরু হয়। ব্রাজিলে করোনার হটস্পট সাও পাওলো ও রিও দে জেনিরোতে তিন হাজারজনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। অন্যদিকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তত্ত্বাবধানেই দক্ষিণ আফ্রিকায় এই টিকার হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করে উইটওয়াটারস্র্যান্ড ইউনিভার্সিটি  তথা উইটস। বেছে নেওয়া হয় ২ হাজার জন স্বেচ্ছাসেবককে। ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় অক্সফোর্ডের টিকার ট্রায়ালের রিপোর্টও ভালর দিকেই বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here