সাম্প্রতিককালে তরুণ প্রজন্মের যেসব লেখক ছোটগল্প চর্চা করছেন, নিঃসন্দেহে সুজয় চক্রবর্তী তাদের মধ্যে অন্যতম একজন প্রতিশ্রুতিবান লেখক। সুজয় মূলত ছোট কাগজের লেখক, লিটিল ম্যাগাজিন তার বিচরণ ভূমি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং সমাদৃত হয়েছে পাঠকমহলে। আমি নিজেও তার একজন গুনগ্রাহী পাঠক।
সম্প্রতি সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সুজয়ের সাম্প্রতিকতম গল্পগ্রন্থ ‘যায় যায় দিন।’ বারোটি ছোটগল্পের সংকলন। ঝরঝরে গদ্য, টানটান গল্পের বাঁধুনি, গল্প বলার ধরনটিও সহজ-সরল। পড়তে পড়তে একবারের জন্যেও হোঁচট খেতে হয় না। অনায়াস দক্ষতায় পাঠককে পড়িয়ে নিতে পারেন তিনি।
সুজয়ের গল্পের বিষয় সমকাল। মানবিক সম্পর্কের গল্প লিখতেন তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। নারী-পুরুষের প্রেমের রসায়ন তার গল্পে অন্য মাত্রা পায়। সুজয় আসলে নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না- ভালোবাসার ছবি আঁকতে বেশি ভালোবাসেন।
প্রথম গল্প ‘সম্পর্কের কাটাকুটি’ গ্রন্থের বারোটি গল্পের মধ্যে অন্যতম ভালো একটি গল্প। প্রথম গল্পেই তিনি জাত চেনাতে সক্ষম। ‘শালা মাগি, আবার ভ্রু প্লাক করে এইচে । আমারে বশ করবি! সে গুড়ে বালি!’ কেবল ক্ষোভ উগরে শান্ত হয় না গৌরদা। উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ঘুমন্ত স্ত্রীর শোবার ঘরে একরকম জোর করেই আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে শেকল তুলে দিয়েছিল।’ -এরকম দু’একটি আচড়েই গল্পের চরিত্রগুলিকে তিনি জীবন্ত করে তোলেন।
দ্বিতীয় গল্প ‘বছর দশ পর’ একটি ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। বিয়ের 10 বছর পর স্বামীর অন্য সম্পর্কের কথা জানতে পারলে যে কোন মেয়ের কাছে অর্থহীন হয়ে যায় দাম্পত্য। ঝিনুক ব্যতিক্রম নয়, সেও এমন বিশ্বাসহীন, ভালবাসাহীন সম্পর্কে আস্থা হারায়। তবুও শেষ পর্যন্ত লম্পট স্বামীকে ছেড়ে যেতে পারেনা ছোট সন্তান আর বৃদ্ধ শশুর মশায়ের কথা ভেবে। লেখক একটা সম্পর্কের গল্প শোনাতে শোনাতে পাঠকের অগোচরেই অন্য এক সম্পর্কের গল্প তৈরি করেন এভাবে।
জাত শিল্পীর বিষয় ধর্মীয় বিভেদ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কিছু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের (দু’পক্ষেরই) হস্তক্ষেপে সমস্যার সমাধান হয়। সেই সাথে গল্পের মূল চরিত্র সাকিল পাই শিল্পীর স্বীকৃতি। শিল্পীর কোনও জাত হয়না, ধর্ম হয় না। সৃষ্টিই তার ধর্ম।
স্টেশনের ভিখারি লক্ষী মাসি আর লরির খালাসী কালো ময়রার সম্পর্কের গল্প ‘কালো ময়লা।’ কালো ইদানিং মদ খেয়ে বেঁহুশ হয়ে থাকে সবসময়। কেননা তার বউ পালিয়েছে নারাণের সঙ্গে, কেননা কালোকে দেখতে কুৎসিত। ঘটনার আপেক্ষিকতায় এই কালো ময়রা একদিন লক্ষ্মী মাসির সান্নিধ্যে এসে পড়ে এবং তাঁরই সাহচর্য্যে আবার সে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় ।
‘টেক্কা’ গল্পে আমরা দেখি আজকের ভোগবাদী সমাজের করুণ পরিণতি। এ গল্প স্কুলশিক্ষক নিশিকান্ত বাবু ভার্সেস ঠিকাদার ছোটন সমাদ্দারের অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার গল্প। সম্পর্কে এরা একে অপরের ভায়রাভাই। আরও স্পষ্ট করে বললে, প্রতিদ্বন্দিতা এদের স্ত্রীদের মধ্যে। বিশেষ করে নিশিকান্তবাবুর স্ত্রী তার বোনের এই বাড়বাড়ন্ত কিছুতেই ভালোভাবে মেনে নিতে পারেন না। ঈর্ষার আগুনে পোড়েন আর বোনের সাথে বৈভবের দেখনদারির পাল্লা দিতে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন স্বামীকে। স্ত্রীর বদ বায়না পূরণ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে একজন শিক্ষক ক়ীভাবে সমাজের চোখে হাস্যকর হয়ে ওঠেন, সেটাই এই গল্পের মূল বিষয় এবং আমার অন্যতম ভালোলাগা আরো একটি গল্প।
‘একটি প্রেমের গল্প’ বাস্তবিক অর্থেই একটি সুন্দর প্রেমের গল্প। সুজয় নারী-পুরুষের সম্পর্কের রসায়ন খুব ভালো বোঝে সে কথা আগেই বলেছি। উত্তম পুরুষে লেখা লেখক আর শিউলির সম্পর্কের রসায়ন এবং গল্পের শেষ পরিণতি আমাদের মনকে আরাম দেয়।
‘চক্রান্ত’ গল্পের মূল চরিত্রের নাম শেফালী। শেফালী হাসতে ভালোবাসে। কারণে হাসে, অকারণেও হাসে। থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় একরকম জোর করেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। পাত্র ইঞ্জিনিয়ার। সবদিক দিয়েই ভালো। দোষের মধ্যে একটু যা সন্দেহবাতিক রোগ।’ সবচেয়ে সন্দেহজনক শেফালির হাসি…। ব্যাপারটাকে সে ভালোভাবে নিতে পারে না। পরিণতি? সবটা বলে দেওয়া ঠিক হবেনা, গল্পের শেষটা পাঠকের জন্য তোলা থাক।
আরও একটি অত্যন্ত ভালো গল্প ‘দুটো কথা বলার লোক।’ এ গল্প একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ের। অত্যান্ত দরদ দিয়ে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন শারমিনের চরিত্রটি, সেই সাথে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজের হৃদয়হীন নিষ্ঠুর দিকটিও। প্রায় এক ঘরে হয়ে যাওয়া, একাকীত্বে ভোগা শারমিন যে কারণে ‘দুটো কথা বলার লোক’ খুঁজতে বেছে নেয় সার্কাসের জীবন। কেননা সেখানে তার মত আরও অনেকে আছে।
তবে কেবল সম্পর্ক নয়, সমকালীন সমাজ অর্থনীতিও তার অনুভবি মনকে বিব্রত করে, আহত করে। এমনই একটি গল্প ‘রং। একটা বয়সের পরে ছেলেদের চাকরি না পাওয়া আর মেয়েদের বিয়ে না হওয়া দুটোই সমান যন্ত্রণাদায়ক। সমাজ, পরিবারের কাছে ভার হয়ে উঠতে হয়। আমাদের সমাজে চাকরির ক্ষেত্রে রাজনীতির রং অনেককাল আগে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সম্প্রতি এই রং প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। সমসাময়িক রাজনীতির এই নতুন উপদ্রবে সুজয় বিব্রত বোধ করেন।
গ্রন্থের সমস্ত গল্প নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা ঠিক নয়, তাতে পাঠকের আগ্রহে ভাটা পড়তে পারে। এটুকুই শুধু বলতে পারি, ‘যায় যায় দিন’ পাঠককে বঞ্চিত করবে না। বরং সুজয়ের চোখ দিয়ে চারপাশের সমাজটাকে আরো একবার নতুন করে অনুভব করার সুযোগ হবে। সুজয় সংবেদনশীল, মানবিক, উদার চিন্তার মানুষ। তার ভাবনা যে ভবিষ্যতে পাঠককে দিশা দেখাবে এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।
সুজয়ের জন্য শুভকামনা রইল।
যায় যায় দিন
সুজয় চক্রবর্তী
সৃষ্টিসুখ প্রিন্ট
মূল্য 125 টাকা