দেশের সময় ওয়েব ডেস্কঃ ভোর তখন সাড়ে তিনটে। বায়ুসেনার ওয়েস্টার্ন কম্যান্ড যে তারও এক ঘণ্টা আগে থেকে সক্রিয়, তা নাকি সিভিল এয়ার সিস্টেমেও আঁচ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ঘটনা যে এ দিকে এগোচ্ছে কে জানত!

ভোর রাতে, তখনও নিকশ অন্ধকারের মধ্যে ভারতীয় বায়ুসেনা প্রথম আঘাত হানল পাকিস্তানের বালাকোটে। সাউথ ব্লক সূত্র জানাচ্ছে, মিনিট পনেরোর অপারেশনেই নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে খাইবার-পাখতুনখোয়া অঞ্চলে জঙ্গি শিবির একেবারেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর যদিও দাবি করেছেন, পাকিস্তানের বায়ুসেনাও যথাযথ জবাব দিয়েছে। তার ফলে ভারতীয় লড়াকু বিমানগুলি কোনও রকমে বোমা ফেলে পালিয়েছে। তাই কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

কিন্তু বায়ুসেনা সূত্রে খবর, ভারতের অপারেশন প্রথম দফায় সফল। এ দিন ভোর রাতে মুজফ্‌রাবাদে সেক্টর দিয়ে নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে প্রবেশ করে ভারতীয় বায়ুসেনার মিরাজ ২০০০ বিমান। বালাকোটের দূরত্ব সেখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল। সাউথ ব্লক জানাচ্ছে, ১২ টি মিরাজ যখন নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে ওপারে ঢোকে তখন টেরও পায়নি ইসলামাবাদ। তার পর এক হাজার কেজি ওজনের বোম দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বালাকোটের সমস্ত জঙ্গি শিবির।

নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গি ঘাঁটিগুলিতে ভারতীয় বায়ুসেনার অভিযানের প্রশংসায় মুখমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার সকালেই টুইটে বায়ুসেনাকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেছেন, বায়ুসেনার আরেকটা অর্থ, ভারতের অবাক করা যোদ্ধা। টুইটারে এই মর্মে পোস্ট করে মমতা বলেছেন, ‘আইএএফ–র আরেকটা অর্থ ইন্ডিয়াস অ্যামেজিং ফাইটার্স। জয় হিন্দ’‌।
মঙ্গলবার ভোর ৩.‌৩০ মিনিট থেকে টানা ২১ মিনিট ধরে পাক অধিকৃত কাশ্মীর বা পিওকে–তে অবস্থিত পাক জঙ্গি ঘাঁটিগুলিতে ১২টি মিরাজ–২০০০ যুদ্ধবিমান নিয়ে অভিযান চালিয়েছে বায়ুসেনা। বায়ুসেনার দাবি, লঞ্চ প্যাডগুলি খালি করতে পারলেও প্রশিক্ষণ শিবির খালি করতে পারেনি জঙ্গিরা। কমপক্ষে ৩০০ জঙ্গি নিকেশ হয়েছে। ভারতীয় বায়ুসেনার অভিযানের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন পাক সেনাপ্রধানও।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে জঙ্গি হামলার নেপথ্যে ছিল পাক জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ ই মহম্মদ। জইশ চিফ মাসুদ আজহার ও তার ভাই আকছার বালাকোটে জঙ্গি শিবিরে যায়। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে সেটাই তাদের মূল ঘাঁটি।

বায়ুসেনা সূত্রে জানা যাচ্ছে, পাকিস্তানের দিক থেকে সম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণ ঠেকানোরও প্রস্তুতি সমান্তরাল ভাবে নিয়ে রেখেছিল নয়াদিল্লি। ১২ টি মিরাজ বিমান যখন বালাকোটে হামলা চালাচ্ছে, তখন নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর উড়ান শুরু করে দেয় ভারতীয় সেনা বাহিনীর এয়ারবর্ন আর্লি ওয়ার্নিং এয়ারক্রাফ্ট। তা ছাড়া একটি সি-১৭ গ্লোবমাস্টার ও একটি এন-৩২ বিমানে সেনা জওয়ানও মজুত রাখা হয়েছিল নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর। দু’টি বিমানে মিলিয়ে ১৯০ কম্যান্ডোকে ‘ব্যাটল রেডি’ রাখা হয়েছিল সম্ভাব্য অপারেশনের জন্য।

বস্তুত গত কয়েকদিন ধরে যেভাবে জম্মু ও কাশ্মীরে জ্বালানির সংকট তৈরি হয়েছে, তা দেখে অনেকেই মনে করতে শুরু করেছিলেন, পাকিস্তানের উপর এ বার আক্রমণ অনিবার্য হতে চলেছে।

তবে কৌতূহলের বিষয় হল, এক রাতেই কি অপারেশন শেষ করে ফেলেছে নয়াদিল্লি? এ ব্যাপারে বায়ুসেনা অবশ্য সরকারি ভাবে কিছু জানায়নি। তবে ওয়েস্টার্ন কম্যান্ডো আই-এল -৭৮ বিমানের গতিবিধি দেখে অনেকে মনে করছেন, পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গি শিবিরে বায়ুসেনা ফের আঘাত হানতে পারে। আই এল-৭৮ আদতে পরিবহণ বিমান। ওগুলি থেকে মধ্য আকাশে জ্বালানি সংগ্রহ করে লড়াকু বিমানগুলি। অর্থাৎ ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয় রাশিয়ায় তৈরি আইএল-৭৮ কে।

পুলওয়ামার জবাব দিতে শুরু করে দিল ভারত। নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে পাকিস্তানের ভূখন্ডে থাকা একের পর এক জঙ্গি ঘাঁটি উড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় বায়ু সেনা। সেনা সূত্রে খবর, মঙ্গলবার ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ এই স্ট্রাইক শুরু করে। এবং ১০০ শতাংশ সফল অপারেশন হয়েছে বলে খবর।

জানা গিয়েছে বায়ুসেনার ১২টি মিরাজ-২০০০ যুদ্ধবিমান সীমানা পেরিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে কার্পেট বম্বিং শুরু করে। প্রায় এক হাজার কিলো বোমা বর্ষণ করা হয় জঙ্গি ক্যাম্পগুলির উপর। সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে স্ট্রাইক করেছিল ভারত তা পুরোপুরি সফল।

বালাকোট থেকে পাক অধ্যুষিত কাশ্মীরের প্রায় ৮০ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে পরে ভারতীয় বায়ুসেনার ১২টি যুদ্ধবিমান। গুঁড়িয়ে দেওয়া একের পর এক জইশ ই মহম্মদের লঞ্চপ্যাড। মাসুদ আজহারের সংগঠনের কন্ট্রোল রুম আলফা-৩ ও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেল সওয়া তিনটে নাগাদ কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলা চালিয়েছিল পাক মদতপুষ্ট জইশ ই মহম্মদ। প্রাণ গিয়েছিল ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের। সেই শোকের মাঝেই নয়া দিল্লি জানিয়েছিল বাবলু সাঁতরা, সুদীপ বিশ্বাসদের হত্যার বদলা হবেই। এবং তা খুব শিগগির। হলোও তাই। ১২ দিনের মাথায় পাকিস্তানকে উপযুক্ত জবাব দিল ভারত।

২০১৯-এর ২৬ ফেব্রুয়ারির এই স্ট্রাইক মনে করাচ্ছে ২০১৬-র ২৯ সেপ্টেম্বরকে। উরিতে জঙ্গি হানার বদলা নিতে ওই দিন পাকিস্তানে ঢুকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী। অনেকেই মঙ্গলবার ভোরের অপারেশনকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক পার্ট টু বলতে শুরু করেছেন।

প্রসঙ্গত, পুলওয়ামা কাণ্ডের পর ফুঁসছিল ভারত। পৃথিবীর একাধিক দেশ সমালোচনা করেছে পাকিস্তানের। রাষ্ট্রসঙ্ঘেও কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল ইমরান খানের পাকিস্তান। ঘটনার কয়েক দিন পর এক রকম চাপে পড়েই সাংবাদিক সম্মেলন করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেখানে নিজের দেশের সাফাই গেয়ে ইমরান বলেন, নয়াদিল্লি যদি প্রমাণ দিতে পারে তাহলে অবশ্যই পাক প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। ইমরানের ওই কথা শেষ হওয়ার পরপরই নর্থ ব্লক বলে দেয়, জইশ-এর মাথা মাসুদ আজহার পাকিস্তান অধ্যুষিত পাঞ্জাবের বাহাওয়ালপুরে বসে রয়েছে। যান গিয়ে ধরুন। তারপর পাকিস্তান এ-ও জানায় বাহাওয়ালপুরের জইশ হেড কোয়ার্টারসের দখল তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ডিগবাজি দেয় পাকিস্তান। জানায়, ওখানে মাদ্রাসা রয়েছে। পড়াশোনা হয়। ওখানকার সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনের কোনও যোগ নেই।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালেই ডেকে দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠক। সেই বৈঠকের পর একটি অনুষ্ঠান থেকে জানিয়েছিলেন, তিনি পারমিশন দিয়ে দিয়েছেন প্রত্যাঘাতের। কিন্তু কবে, কখন, কীভাবে প্রত্যাঘাত তা ঠিক করবে সেনাবাহিনী। এ দিন সেই প্রত্যাঘাত হানল ভারত। সকাল সাড়ে নটা নাগাদ টুইট করে ভারতীয় বায়ুসেনার পাইলটদের কুর্নিস জানান কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here