চিরঞ্জিত আর শরিফ চাচার কথা: অশোক মজুমদার

0
530

খুব রাগ হচ্ছে। নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে। জীবনের শেষ ইনিংসে এসে ভাবছি কী করেছি আমি? কিছু ছবি তোলা, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে হইহুল্লোড়, মদ্যপান করে সাহিত্য বিপ্লবের বুলি আওড়ানো, পড়াশোনা ছাড়াই সব বিষয় নিয়ে কথা বলা, রাজনৈতিক নেতাদের গালাগালি করে শখের বিপ্লবী সাজা ছাড়া আর কিছুই তো করিনি।

জীবনের অর্ধেক সময়টাই পরনিন্দা, পরচর্চা, মানুষের দুর্ভোগ দেখেও চুপ করে থেকেছি। নিজের পরিবার ছাড়া কোন মানুষের কথা ভাবিনি।

কোনকিছুর ভিতরে না গিয়ে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের কিছু উদ্ধৃতি দিয়েই জীবন কাটিয়ে ফেলছি।

পরিবারের বাইরের দুনিয়ায় বিন্দুমাত্র অবদান যেমন রাখিনি তেমন সংসারের প্রতিও যে খুব মন দিয়েছি এমন সুনামও কিন্তু নেই, আসলে সমাজ সংসার দুইয়ের প্রতিই আজও উদাসীন হয়ে কাটিয়ে দেওয়া আপাদমস্তক স্বার্থপরতার ভাইরাসে আক্রান্ত আমি। বুঝতে পারছি এটা করোনার চেয়েও মানসিকভাবে আমার অনেক ক্ষতি করেছে।
কারণ যমরাজের ডাক আমি শুনেও না শোনার ভান করে আছি। চিত্রগুপ্তের বিচার সভায় আমার কোন কাজই আমাকে স্বর্গে পৌঁছতে সাহায্য করবে না, আমার স্থান হবে নরকে। নরক কেমন তার প্রাথমিক পরিচয় আমি পৃথিবীতেই পেয়েছি। শাস্তি হওয়ার পর যে নরক আমি দেখবো তা এই পৃথিবীর চেয়ে বেশি হবে না।

আমি নাস্তিক মানুষ, কোন মাটি, পাথর আমার দেবতা নয়, আমার দেবতা মানুষ। যার রক্ত, প্রাণ আছে, আনন্দ, কষ্ট, দুঃখ বুঝতে পারে।

স্কুল জীবনে পড়ার সময়ে মিশনের মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঈশ্বরের মনোরঞ্জনের জন্য আমরা এত চেষ্টা করি, অথচ চারপাশের মানুষগুলোর জন্য কিছু করি না কেন? মহারাজ সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন, তুমি বড় হও, কাজের ভিতরেই সব উত্তর পাবে। দুঃখের সময় মানুষের সেবা করাটাই ঈশ্বর দর্শন।

বর্তমানে আমার চারপাশে যা দেখছি তা ভয়ঙ্কর। করোনার সময় মানুষের দাঁত, নখ বেরিয়ে আসছে। কালী ঠাকুরের দুপাশে থাকা সেই ভয়ঙ্কর ভূতপ্রেতগুলির নৃত্য চলছে চারদিকে। একটা ভাইরাস আমাদের প্রতিনিয়ত নানা কিছু শিখিয়ে যাচ্ছে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে যখন বাংলায় করোনা প্রবেশ করলো, তখন আমার মনে হল, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা দরকার।

তখন থেকেই ‘মানবিক পরিষেবা’ নামে নিজের উদ্যোগে আমার বন্ধু ও চিত্রসাংবাদিকদের নিয়ে মানুষকে সহায়তা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এতে নিজের একটা ভালোলাগাও আছে।

কিন্তু সম্প্রতি দু’জন মানুষের কথা সংবাদ মাধ্যমে জানার পর আমার দিনরাত শুধু এটাই মনে আসছে,

আমি এমন কি করছি? দু-চার জন মানুষকে একটু চাল, ডাল, ওষুধ, সামান্য অর্থ দিয়ে নিজেকে মহান ভাবছিলাম, কিন্তু এদের কাজ ও মানসিকতার ধারে কাছে আমি কি কোনদিন যেতে পারবো?

এই দুজনের কথাই এখন বলবো।

চিরঞ্জিত ধীবর দুর্গাপুরের এক স্কুল শিক্ষক। করোনা প্রতিষেধক পরীক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তিনি। এই মুহূর্তে কো-ভ্যাকসিন ট্রায়ালে তিনি ভুবনেশ্বরে আছেন। করোনা প্রতিষেধকের প্রথম ডোজ তার শরীরে দেওয়া হয়েছে, ভালো আছেন। এই ট্রায়াল সবে শুরু হয়েছে, এরপর আরও পরীক্ষা চলবে। তার শরীরটাই একটা পরীক্ষাগার, সম্পূর্ণ আইসোলেশনে আছেন। বন্ধু বিকাশ দাস বাইরে থেকে তার দেখভাল করছেন। সংবাদ মাধ্যম মারফৎ এটুকু খবরই আমি জানলাম।

ভাবছিলাম, আমরা যারা করোনা না হওয়ার জন্য বাড়িতে থেকে রসুন, আদা, হলুদ, তুলসীপাতা যে যা বলছে সব খেয়ে ইমিউনিটি পাওয়ার বাড়ানোর সবরকম চেষ্টা করে চলেছি, তারা কী চিরঞ্জিতের মত মানুষদের মানসিকতার ধারে কাছে আসতে পারবো?

স্বার্থপরের মত শুধু নিজেদের বাঁচানো এবং বাকি সময়টুকু সরকারের সমালোচনা করা ছাড়া আমরা আর কী করি? টিভির ‘ঘন্টাখানেকের’ করোনা বিশারদ, যারা করোনা নিয়ে পিএইচডি করে ফেলেছেন তারা এমন একটা উদ্যোগের কথা ভাবতে পারবেন? কতটা সাহস ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে একাজ একজন মানুষ করতে পারেন!

বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমি তো পারতাম না। চিরঞ্জিত প্রকৃতই শিক্ষক। ওঁর শিক্ষার মর্যাদা সমাজের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। এমন মানুষকে অন্তর থেকে প্রণাম জানাই।

এবার বলি, অযোধ্যার শরিফ চাচার কথা। তিনি নীরবে বেওয়ারিশ মৃতদেহ সৎকার করে চলেছেন। এটা একইসঙ্গে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এতে ঝুঁকি আছে, তবুও শরিফ চাচা নীরবে নিজেকে একাজে উৎসর্গ করেছেন। চিরঞ্জিতের মত মৃত্যু ভয় তুচ্ছ করেছেন তিনিও। ব্যাক্তিগত ট্রাজেডি মানুষকে হয় সংসার বিমুখ করে তোলে কিংবা প্রতিহিংসা পরায়ণ। কিন্তু শরিফ চাচার ক্ষেত্রে এমন কিছুই ঘটেনি।
দুঃখকে তিনি সেবায় পরিণত করেছেন, শোককে ভালোবাসায়। এখনও অবধি ৩০৭৯ টা মৃতদেহ সৎকার করেছেন তিনি। হিন্দু-মুসলমান কোন ভেদাভেদ করেননি। অথচ তার নিজের জীবনেই ঘটে গেছে এক বিরাট দুঃখজনক ঘটনা। ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর খুন হয়েছে, তার মৃতদেহও পাননি। ছেলেকে নিজের হাতে কবর দেওয়ার বহু চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। সেই থেকেই প্রতিজ্ঞা করেন বেওয়ারিশ মৃতদেহ নিজের হাতে সৎকার করবেন।

৮০-র কোঠায় পৌঁছনো এই মানুষটি সেবা ধর্মের সুবাদে পদ্মশ্রী পেয়েছেন।

চিরঞ্জিত এবং শরিফ চাচার সঙ্গে যোগাযোগ করার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। পারলে জানতে চাইতাম এইরকম মানবিক মন তৈরি করতে গেলে মানুষকে কি করতে হয়? কোথা থেকে আসে এমন সাহস? কীভাবে হওয়া যায় এতটা স্বার্থশূন্য? মন্দির ও মসজিদকে কীভাবে দেখেন আপনারা? এমন বহু প্রশ্ন এই দুজনের জন্য আমার মনে অপেক্ষা করে আছে।

সামান্য একটু কাজ করে আমরা কত বড় বড় কথা লিখি, বলি। সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যা,ধোনির অবসর, রাম মন্দির, জন্মাষ্টমী, পাড়ায় পাড়ায় খিচুরি বিতরণ, চাকরি জীবনের সাফল্য, ভালো রেস্তরাঁয় খাওয়া, ব্র্যান্ডেড পোশাক পরা, কত কিছু আমাদের আলোচনার টপিক!

এরমধ্যে চিরঞ্জিত বা শরিফ চাচার মত মন তৈরি হওয়ার কোন পরিসরই তো নেই। নিজের স্বার্থ ছাড়া আমরা কিছুই ভাবতে পারিনা। তাই আমাদের মত জন্ম বৃদ্ধ এবং খর্বকায় মানুষের মনের আকাশে এরা দূরের তারা হয়ে জেগে থাকেন।

আসলে আমরা বেঁচে থেকেও মরে আছি। কিন্তু আসলে বেঁচে আছেন এরা এবং থাকবেনও শুধু এরাই। যে কারণেই চিরঞ্জিত আর শরিফ চাচাদের মধ্যেই আমরা ধর্মের মানবিক চেহারাটা দেখতে পাই।

অশোক মজুমদার।।

Previous articleঅবসর নিতে এত দেরি কেন? প্রশ্ন রয়ে গেল ধোনিকে নিয়ে 
Next articleপ্রয়াত তৃণমূল বিধায়ক সমরেশ দাস,শোকবার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here